ভারতবর্ষে নির্বাচনের ইতিহাস এবং এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিপুল জয়ের সম্ভবনা
১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ সালে দুইশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারতবর্ষ স্বধীন হয়। বিশ্বের বৃহত্তম গনতন্ত্র ভারতবর্ষে স্বাধীনতার পর থেকেই অন্যান্য গনতান্ত্রিক দেশের মতোই সাধারন নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন হয়। স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিল যদি ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেওয়া হয় তাহলে ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হবে। কিন্তু উইনস্টন চার্চিলকে ভুল প্রমানিত করে স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও ভারতের গনতান্ত্রিক পরিকাঠামো অক্ষুন্ন রয়েছে। প্রত্যেক দেশেই কোনও না কোনও সমস্যা রয়েছে কিন্তু তা সত্বেও দীর্ঘদিন ধরে বিভন্ন জাতি, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ দেশ হিসাবে গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার নির্বাচিত হয় ভারতে যা বিশ্বের বাকী দেশগুলোর জন্য উদাহারন স্বরূপ।
ভারতীয় সংবিধানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই ধরনের নির্বাচনের ব্যবস্থাই রয়েছে। প্রত্যক্ষ নির্বাচনে দেশের জনগন বিধানসভা ও লোকসভার প্রতিনিধি নির্বাচন করে। এই প্রতিনিধিরা ঠিক করে দেশে সরকার গঠন কে করবে। নির্বাচনে যে প্রার্থী প্রতিপক্ষের থেকে বেশী ভোট পায় সেই জয়ী হয়। পরোক্ষ নির্বাচন হয় রাজ্যসভা, রাজ্য আইনসভা, রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই এখানে ভোট দিতে পারে। এখানে জিততে গেলে বিজয়ী প্রার্থীকে ৫০ শতাংশের বেশী ভোট পেতে হয়। দেশে নির্বাচন সুষ্ঠ ভাবে হওয়ার জন্য সংবিধানের ধারা ৩২৪ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন তৈরি করা হয়েছে। ভারতে নির্বাচন প্রথম হয় ব্রিটিশ শাসনে ১৮৫৩ সালে চার্টার আইন অনুযায়ী ভারতে প্রথম বিধানসভা তৈরি করা হয়। এখানে প্রথমে ব্রিটিশদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই থাকতে পারতো। ১৮৯২ সালের ভারত সরকারের আইন অনুযায়ী সর্বপ্রথম বিধানসভার প্রতিনিধিদের পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়োগ করার কথা বলা হয় এবং ১৯০৯ সালের আইন অনুযায়ী প্রত্যক্ষ নির্বাচনের কথা বলা হয়। তবে এসব নির্বাচনে ভোটদানের অধিকার খুবই সীমাবদ্ধ ছিল যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করা হয়। ভারতীয় সংবিধান তৈরিতে হওয়ার পর ইউনিভার্সাল অ্যাডাল্ট ফ্রাঞ্চাইজ নিয়ে আসা হয় অর্থাৎ ২১ বছর বয়সী প্রত্যেক ভারতবাসী বিধানসভা ও লোকসভাতে ভোট দিতে পারবে।
১৯৮৮ সালে ৬১তম সাংবিধানিক সংশোধন অনুযায়ী ভোটদানের নূন্যতম বয়স ২১ বছর থেকে কমিয়ে ১৮ বছর করে দেওয়া হয়। স্বাধীন ভারতে প্রথম সাধারন নির্বাচন হয় ১৯৫১-৫২ সালে। এই নির্বাচনে ১৭ কোটি ভোটার ৪৮৯ লোকসভা কেন্দ্রে ভোট দিয়েছিল। যদিও সেসময় ৩৬ কোটি ভোটার ছিল। লোকসভা আসনের সংখ্যা বর্তমানে বাড়তে বাড়তে ৫৫০টিতে এস পোঁছেছে কিন্ত ভোট হয় ৫৪৩টি আসনে। প্রথম সাধারন নির্বাচন ৬৮ দফায় হয় যাতে ৪৪.৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল। এই নির্বাচনে জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে ভারতের জতীয় কংগ্রেস ৩৬৪ আসনে জয়ী হয়েছিল। ১৬টি আসন নিয়ে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিল ভারতের কমিউনিস্ট দল সিপিআইএম। ভারতের প্রথম নির্বাচনে ১৪টি জাতীয় রাজনৈতিক দল এবং ৩৯টি রাজ্যস্তরের রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনেরও অংশগ্রহন করেছিল। বর্তমানে সেই ১৪টি জাতীয় রাজনৈতিক দলের মধ্যে মাত্র দুটি দল কংগ্রেস ও সিপিআইয়ের অস্তিত্ব রয়েছে।
১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু জরুরী অবস্থা এবং অন্যান্য কিছু কারনে ১৯৭৫ সালের পর কংগ্রেসের প্রভাব কমতে শুরু করে। ১৯৭৭ সালে পরাজয়ের পর ১৯৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস পুনরায় ক্ষমতায় আসে এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল। ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের পরাজয়ের পর ভারতের রাজনীতিতে একটি নতুন নীতির উদ্ভব হয় তা হল জোট রাজনীতি যা পরবর্তী ২৫ বছর পর্যন্ত চলে। এইসময়ে তামিলনাড়ুতে ডিএমকে, উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী দল, বহুজন সমাজবাদী দল, বিহারে আরজেডি, জেডিইউ এর মতো দলের প্রভাব বৃদ্ধি পায় রাজ্য রাজনীতিতে।
১৯৭৫ সালে জরুরী অবস্থার কারনে কংগ্রেস দুর্বল হয়ে পড়ে যার সুযোগে এসব দলের উত্থান হয়। ১৯৮৪ সালের পর সাধারন নির্বাচনে কোনও দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ১৯৭৭ সালে মোরারজী দেশাই এর নেতৃত্বে জনতা পার্টি ৮৫৭ দিনের জন্য ক্ষমতায় এসেছিল। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এটাই প্রথম অকংগ্রেস সরকার ছিল। কিন্তু ১৯৭৯ সালে এই দল ভেঙে যায় এবং চৌধুরী চরন সিং এর নেতৃত্বে বিভিন্ন দল মিলিতভাবে সরকার গঠন করে। তবে এই সরকারও মাত্র ১৭১ দিন স্থায়ী ছিল। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সমস্ত জোটদলই মিলিত ভাবে ভারতের শাসনক্ষমতায় থাকে। জোট রাজনীতিতে ১৯৯১ সালে পিভি নরসীমা রাও, ১৯৯৯ সালে বিজেপির অটল বিহারি বাজপেয়ী এবং ২০০৪ ও ২০০৯ সালে ডঃ মনমোহন সিং এর নেতৃত্বে কংগ্রেসের ইউপিএ সরকার পূর্ন সময়কাল ক্ষমতায় ছিল।
২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের ইউপিএ২ সরকারকে পরাজিত করে বিজেপি ক্ষমতায় আসে। বিজেপির মাধ্যমে ২৫ বছর পর কোনও একক দল সরকার গঠন করে। শ্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে গুজরাট মডেলের সাফল্য এবং ১৯৯০ এর দশকে বিজেপির রাম জন্মভূমি আন্দোলন ভারতে বিজেপিকে শক্তিশালী করে যার জন্য হিন্দু ভোটের সিংহভাগ বিজেপির দিকে চলে যায়। যে বিজেপি ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সেই বিজেপিই একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে উত্তরপ্রদেশে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা সমাজবাদি দল ও বহুজন সমাজবাদি দলের জোটকেও বিজেপি পরাজিত করে উত্তরপ্রদেশেও তাদের শক্ত ভিত তৈরির করে। বেশ কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে দেশের মধ্যবিত্ত ভোটারদের একটি বড় অংশ বিজেপিকে ভোট দিচ্ছে।
দেশজুড়ে শুরু হওয়া আঠারোতম লোকসভা নির্বাচনেও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞগনের বক্তব্য বিজেপি ২০১৯ সালের থেকেও বেশী আসন নিয়ে পুনরায় সরকার গঠন করবে। স্বাধীনতার পরবর্তী চল্লিশ বছরে ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের প্রভাব ছিল, তার পরবর্তী পঁচিশ বছর জোট রাজনীতি কার্যকর হয় ভারতের সরকার গঠনের ক্ষেত্রে। এবার কয়েকবছর অন্তত বিজেপির প্রাধান্য থাকবে ভারতের রাজনীতিতে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। বিজেপি এবার ৪০০ এর বেশী আসন জেতার লক্ষ্য নিয়েছে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এবার নজর রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে ২০১৯ সালের তুলনায় আরও ভালো ফল করার। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টি আসন জিতেছিল বিজেপি। সেজন্য বিজেপি এবার পশ্চিমবঙ্গে ৩৫টি আসনে জেতার লক্ষ্য নিয়েছে। বিখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রশান্ত কিশোরও মনে করে এবার রাজ্যে বিজেপি গতবারের তুলনায় আরও ভালো ফল করবে। প্রশান্ত কিশোরকে ভারতে রাজনীতির মাস্টারমাইন্ড বলা হয়। অতীতে বহু রাজ্যে প্রশান্ত কিশোরের নেতৃত্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আশাতীত সাফল্যের পর শাসকদল তৃনমূল কংগ্রেস প্রশান্ত কিশোরের সাথেই যোগাযোগ করেছিল ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে আটকাতে। প্রশান্ত কিশোরের নেতৃত্বে তার আইপ্যাক সংগঠন ২০২১ সালে রাজ্যে বিজেপিকে আটকে দিয়েছিল। এবারের লোকসভা নির্বাচনেও আইপ্যাক তৃনমূল কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচনী প্রচারে যুক্ত রয়েছে তবে প্রশান্ত কিশোর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। সেই প্রশান্ত কিশোরের দাবী বিজেপি অন্তত ৩৭০ আসন পেতে পারে এই লোকসভা নির্বাচনে। কিছু সমীক্ষা এটাও জানিয়েছে বাংলায় ২০টি করে আসন বিজেপি ও তৃনমূল পাবে এবং দুটি আসন কংগ্রেস পাবে। বাংলায় ভালোফল করতে এবারে বিজেপি অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী মোনোনীত করেছে রাজ্য লোকসভা কেন্দ্রে। এদেরই মধ্যে একজন হলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়। যাদবপুর লোকসভার মতো গুরুত্বপূর্ন কেন্দ্রে ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করেছে বঙ্গ বিজেপি। দিল্লির ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রিসার্চ ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও ট্রাস্টি ২০১৯ সাল থেকেই রাজ্য বিজেপিতে একজন সক্রিয় ব্যক্তি। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন থেকে তিনি বাংলায় বিজেপির ভীত শক্ত করার কাজ করে চলেছেন। ২০২১ সালে ডঃ গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই বোলপুর বিধানসভা কেন্দ্রে রেকর্ড পরিমান ভোট পায় বিজেপি। তাই যাদবপুর কেন্দ্রে শাসকদলের প্রার্থী সায়নী ঘোষের বিরুদ্ধে ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়ের উপরেই আস্থা রেখেছে রাজ্য বিজেপি।