অফবিট

রবীন্দ্র কৌশিক। ব্রাহ্মন পরিবারে জন্মগ্রহন করেও কোরান পাঠ করতেন

বর্তমান বিশ্বে প্রত্যেকটি দেশেরই গুপ্তচর সংস্থা রয়েছে যাকে সিক্রেট সার্ভিস বা ইনটেলিজেন্স সংস্থাও বলা হয়। যেমন ভারতের র, ইসরায়েলের মোসাদ, আমেরিকার সিআইএ, রাশিয়ার কেজিবি। এইসব সংস্থায় দেশটির বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত লোক কাজ করে তাদের এজেন্ট বলা হয়। এসব এজেন্টরা বেশীরভাগ সময়ে শত্রু দেশের মধ্যেই ছদ্মবেশে লুকিয়ে থেকে কাজ করে। কিন্তু যদি কোন এজেন্ট ধরা পড়ে যায়, তাহলে যে দেশের সে এজেন্ট, সেই এজেন্টের দায় স্বীকার করবে না, গুপ্তচর দুনিয়ার এটাই নিয়ম। যে দেশের গুপ্তচর সংস্থা যত বেশী শক্তিশালী আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সেই দেশের প্রভাব তত বেশী। ভারতের র বিশ্বের প্রথম সারির গোয়েন্দা সংস্থা গুলোর মধ্যে একটি। আজ র এর এমন একজন এজেন্ট সম্পর্কে আলোচনা করা হবে যার দেশপ্রেম ছিল প্রশ্নাতীত। রবীন্দ্র কৌশিক র এর ইতিহাসে সেরা এজেন্টদের মধ্যে একজন। নিজের পরিবার, দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গিয়ে থাকা এবং দেশের জন্য বলিদান দেওয়ার জন্য ভারত মায়ের এই বীর সন্তানকে অন্তর থেকে প্রনাম। 

রাজস্থানের গঙ্গানগরের ১১ এপ্রিল, ১৯৫২ এ একটি ব্রাহ্মন পরিবারে জন্মগ্রহন করেছিলেন রবীন্দ্র কৌশিক। ওনার বাবা ছিলেন ভারতীয় বায়ুসেনার একজন অফিসার। চার ভাইবোনের মধ্যে রবীন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। খুব ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি টান ছিল তার। কলেজ জীবনেই তিনি থিয়েটারে অভিনয় করতেন। যেহেতু ওনার বাবা ছিলেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর অফিসার সেজন্য দেশপ্রেম তার রক্তেই ছিল। নাটকে বেশীরভাগ সময়ে তিনি সেনাবাহিনীর সদস্যে অভিনয় করতেন। লখনৌতে একবার এক থিয়েটারে তার সেনাবাহিনীর সদস্য পদে অভিনয় চোখে পড়ে কিছু ব্যাক্তির যারা ছিল র এর অফিসার। সেই ব্যাক্তিরা রবীন্দ্রর সাথে যোগাযোগ করে এবং তাকে সরকারি কাজের জন্য দিল্লিতে আসতে বলে। 

দিল্লিতে বিভিন্ন রকম পরীক্ষার পর রবীন্দ্র কৌশিককে র এর ব্যাপারে জানানো হয় এবং তাকে র এ যোগ দেবার কথা বলা হয়। রবীন্দ্র সব শুনেই সম্মতি দিয়ে দেয়। একজন এজেন্টকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, এমন কি সে তার পরিবারকেও জানাতে পারেনা, অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ জীবন একজন এজেন্টের। কলেজ শেষ হবার পর দুই বছরের জন্য অমৃতসরে পাঠানো হয় তাকে। একটি বিশেষ মিশনের জন্য তাকে তৈরি করা হতে থাকে। তাকে পাকিস্তানে গিয়ে সেখানকার তথ্য ভারতে পাঠানোর জন্য তৈরি করা হতে থাকে। একজন পাকিস্তানি হিসাবে তাকে তৈরি করা হয়।গঙ্গানগরে ওনার জন্ম হওয়ায় উনি পাঞ্জাবি জানতেন ভালোভাবেই। কিন্তু পাকিস্তানি হবার জন্য শুধু পাঞ্জাবি জানলেই হবে না, সেইজন্য র রবীন্দ্র কৌশিককে উর্দু শেখানো থেকে শুরু করে নামাজ পড়া, কোরান শেখানো সহ একজন মুসলিম ব্যাক্তি হিসাবে প্রশিক্ষিত করা হয়। তবে সব প্রশিক্ষনের পরও তাকে একেবারে পাকিস্তানে না পাঠিয়ে ছয় সাতটি দেশে পাঠানো হয় পরীক্ষা করার জন্য, যেখানে তার কাজ র এর অনুমানের থেকেও ভালো ছিল। ভারত সরকারের নথিতে রবীন্দ্র কৌশিকের সমস্ত তথ্য মুছে দেওয়া হয় এবং তার নতুন নাম দেওয়া হয় নবি আহমেদ শাকির। পাকিস্তানে তার জন্য রেশন কার্ড, নাগরিক পরিচয়পত্র তৈরি করা হয় এবং তাকে ঘরও দেওয়া হয়। রবীন্দ্র কৌশিককে দীর্ঘকালীন মেয়াদের জন্য পাকিস্তানে রাখার পরিকল্পনা ছিল র এর। যেখানে রবীন্দ্র কৌশিক একজন সাধারন পাকিস্তানি হিসাবে থাকবে, বন্ধু তৈরি হবে তার, স্থানীয় মেয়েকে বিয়ে করবে, সংসার করবে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য ভারতকে পাঠাবে।

১৯৭৫ সালে রবীন্দ্র কৌশিককে পাকিস্তানে পাঠানো হয়। পাকিস্তানে পৌঁছেই রবীন্দ্র কৌশিক করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবিতে ভর্তি হয় এবং সেখানে বেশ কিছু বন্ধুও তৈরি করে। তবে পাকিস্তানে থাকার কিছুদিন পরেও সে কোনও তথ্য পাচ্ছিলনা দেশে পাঠানোর মতোন। একদিন একটি সংবাদপত্র পড়ার সময় তাতে রবীন্দ্র কৌশিক ওরফে নবি আহমেদ শাকির দেখতে পায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার বিজ্ঞাপন। র এর অনুমতি নিয়ে সমস্ত পরীক্ষা পাশ করে সে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় এবং দুই বছরের মধ্যেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর পদে প্রোমোশন হয় তার। রবীন্দ্র কৌশিকের অভিনয় এতটাই নিখুঁত ছিল যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কম্যান্ডারও ধরতে পারেনি সে একজন ভারতীয়। 

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই তার কাছে আসতে থাকে। রবীন্দ্র কৌশিক পাকিস্তান পরমানু কার্যক্রম এবং মিসাইল প্রযুক্তি সম্পর্কিত তথ্য ভারতকে পাঠাতে থাকে। মেজর হিসাবে কাজ করার দুই বছরের মধ্যে সেনাবাহিনীর এক দর্জির মেয়ের আমানতের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং খুব দ্রুত তাদের বিবাহও হয়ে যায়। তাদের এক পুত্রসন্তানও হয়। এবার তো তার পাকিস্তানি হিসাবে পরিচয় আরও মজবুত হয়ে যায়। তবে এসবের মাঝেও দেশের প্রতি কর্তব্য ভোলেননি তিনি। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ অবধি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তিনি র কে দিয়েছিলেন যার জন্য তাকে ব্ল্যাক টাইগার উপাধি দেওয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যন্ত গোপন তথ্য, অপারেশনের খবর র এর আগেই জেনে যেত। ১৯৮১ সালে রবীন্দ্র কৌশিকের ছোট ভাইয়ের বিয়ে ছিল সেজন্য তিনি র এর কাছে আবেদন করেন কিছুদিনের জন্য হলেও দেশে আসার জন্য। র সাধারনত এধরনের কাজে অনুমতি দেয়না, তবে রবীন্দ্র কৌশিকের অনেকবার অনুরোধের পর তাকে অনুমতি দেওয়া হয় এবং দুবাই হয়ে ভারতে আসেন তিনি। বাড়ি ফিরেই তাকে পরিবারের অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় কিন্তু তিনি তার আসল পরিচয় জানাননি কাউকে। পাকিস্তানে আবার ফেরত আসার আগে তিনি তার বাবাকে বলেন এরপর ফিরে এসে তিনি সবকিছু জানাবেন। দুর্ভাগ্যবশত এটাই ছিল পরিবারের সাথে তার শেষ দেখা। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সব ঠিকই চলছিল। কিন্তু ১৯৮৩ সালে এনায়েত নামে একজন র এজেন্ট করাচি হয়ে পাকিস্তানে আসে, রবীন্দ্রর থেকে তথ্য নেবার জন্য। এনায়েত নামটাও একটা আলাদা নাম তার আসল নাম আলাদা। এনায়েত এর আগেও র এর হয়ে কাজ করেছে কিন্তু সে এই প্রথম পাকিস্তানে আসে। কিন্তু এনায়েতকে পাকিস্তান পুলিশ গ্রেফতার করে সন্দেহের বশে এবং তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয় অনেক, ফলে সে বাধ্য হয়ে রবীন্দ্র কৌশিকের পরিচয় বলে দিতে। পাকিস্তান সেনা রবীন্দ্রকে সরাসরি গ্রেফতার না করে এনায়েতকে মুক্তি দিয়ে বলে তাকে রবীন্দ্রর সাথে দেখা করতে বলে। একটি পার্কে সে রবীন্দ্রর সাথে দেখা করে, সেখানেই পাকিস্তান সেনা তাকে গ্রেফতার করে। রবীন্দ্র কৌশিককে অমানবিক অত্যাচার করা হয়। দুই বছর ধরে নৃশংস অত্যাচার করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনেক অত্যাচার করেও রবীন্দ্র কৌশিকের থেকে একটা কথাও বার করতে পারে নি। বাধ্য হয়ে ১৯৮৫ সালে তার জন্য ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু পরে সেই আদেশ বদলে তাকে জেলে পাঠানো হয় কিন্তু সেখানেই টিবিতে আক্রান্ত হয়ে ১ নভেম্বর, ২০০১ সালে তার মৃত্যু হয়। রবীন্দ্র কৌশিক মৃত্যুর আগে তার পরিবারকে কিছু চিঠি পাঠিয়েছিল, সেখান থেকেই তার প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে জানা গেছে। ভারতবর্ষ আজ সামরিক দিক দিয়ে এত শক্তিশালী, পাকিস্তানকে ভারত বারবার পরাজিত করেছে, এসবের জন্য র এর সিক্রেট এজেন্টদের অবদান অনস্বীকার্য। এদের প্রকৃত পরিচয় হয়ত কোনওদিনই জানা যাবে না। রবীন্দ্র কৌশিকের মতোন ভারত মায়ের বীর সন্তানদের সম্মানে কোন শব্দই হয়ত যথেষ্ট নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *