অফবিট

“যখন আমি খাবার দিই তখন তারা আমাকে সাধু বলে, কিন্তু যখন আমি তাদের জিজ্ঞাস করি তাদের কাছে খাবার নেই কেন? তখন তারা আমাকে কমিউনিস্ট বলে”

বিখ্যাত ব্রাজিলিয়ান বিশপ হেল্ডার পেসোয়া কামারা বলেছিলেন “যখন আমি তাদের খাবার দিই তখন তারা আমাকে সাধু বলে কিন্তু যখন আমি তাদের জিজ্ঞাস করি তাদের কাছে খাবার নেই কেন তখন তারা আমাকে কমিউনিস্ট বলে”। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে কমিউনিজম এমন এক সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখায় যেখানে কোনও শ্রেনীভেদ, ধনী গীরবের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ থাকবেনা, যেখানে ধর্ম নিয়ে কোনও লড়াই থাকবেনা, যেখানে সমাজের প্রত্যেক স্তরের মানুষ একে অপরের সাথে কোনও ভেদাভেদ ছাড়াই মিশতে পারবে যেখানে কোনও রাজা, কোনও শাসকের অস্তিত্ব থাকবেনা। কমিউনিজমে বলা হয় কোনও দেশের বিভাজন, সীমান্ত থাকবেনা। কমিউনিস্ট মতবাদ অনুযায়ী জনতাই সব কিছু নিয়ন্ত্রন করবে এবং দেশের অর্থনীতি পয়সা ছাড়াই চলবে। এসব শুনতে পুরো স্বপ্নের মতো মনে হয়, মনে হয় পৃথিবীতে এর থেকে আদর্শ মতাদর্শ বোধহয় কিছু হয়না। এসব শুনত যতটা আকর্ষনীয় বাস্তবে ততটাই ব্যর্থ। কমিউনিজমের আকর্ষনে যুগে যুগে বহু ছাত্র, মানুষ আকর্ষিত হয়েছে কিন্তু বাস্তবে যখন কোনওদেশে কমিউনিজমের স্থাপনা হয় তখন এর বিপরীত চিত্রই দেখা গেছে। বিশ্বের প্রথম ও সবচেয়ে বড় কমিউনিস্ট দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালে ভেঙে যায়। আসলে কোনও পরিকল্পনা তৈরি করা খুবই সোজা কিন্তু বাস্তবে যখন তা প্রয়োগ করা হয় তখন বোঝা যায় এর গ্রহনযোগ্যতা কতটা। কমিউনিজম যে ধরনের দেশ, সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখায় তা বাস্তবে কখনওই সম্ভব নয় যার জন্য কমিউনিজম বর্তমানে বিশ্বের মাত্র চার, পাঁচটি দেশেই রয়েছে।

কমিউনিজম বা সাম্যবাদ কথাটি যখনই আসে তখন সবার প্রথমে যে নামটির কথা মনে হয় তা হল কার্ল মার্ক্স। কার্ল মার্ক্সই সর্বপ্রথম কমিউনিজমকে বিশ্বের সামনে একটি নির্দিষ্ট নীতি অনুযায়ী তুলে ধরে। তবে কমিউনিজমের উৎস এরও কয়েক শতাব্দী আগে। কমিউনিজম শব্দটি ১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর পরে জনপ্রিয় হলেও কমিউনিস্ট সমাজের ব্যাপারে রাজনৈতিক দর্শনের জনক প্লেটো চতুর্থ শতকেই লিখে দিয়েছিল। প্লেটো তার বই দি রিপাবলিকে দুই ধরনের কমিউনিজমের ব্যাপারে বলেছে, সম্পত্তির কমিউনিজম এবং পরিবারের কমিউনিজম। এই বইয়ে প্লেটো একটি আদর্শ সমাজের কথা বলেছেন যেখানে সমাজের শাসকশ্রেনী অর্থাৎ রাজা ও সেনা পুরো সমাজের প্রয়োজনীয়তা পূরন করবে। এর জন্য শাসকশ্রেনীর কাছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পরিবার রাখা যাবেনা। প্লেটোর মতে এই দুটি জিনিস শাসকশ্রেনীকে তার দায়িত্ব থেকে পথভ্রষ্ট করে এবং শাসকশ্রেনী লোভী, দূর্নীতিপরায়ন হয়ে পড়ে। এই জন্য প্লেটো বলেছে শাসকশ্রেনীকে পরিবারের ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির মোহ থেকে বেরিয়ে এসে একটি ঐক্যবদ্ধ পরিবারের মতোন কাজ করার কথা। এই ধরনের চিন্তাভাবনার কারনে প্লেটোকে প্রথম কমিউনিস্ট বলা হয়। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মতেও কমিউনিজমের প্রভাব দেখা যায়। যেমন অ্যাপোস্টিলের নীতি অনুযায়ী প্রথমদিকে একধরনের কমিউনিজম অনুসরন করতো যাতে নিজেদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা যায়। এর মাধ্যমে তারা গীর্জার একচ্ছত্র প্রভাবের অবসান ঘটাতে চাইছিলো। 

১৫১৬ সালে স্যার থমাস মোর তার বই উটোপিয়াতে একধরনের কাল্পনিক সমাজের কথা লিখেছে যেখানে কোনও অর্থব্যবস্থাই থাকবেনা। মানুষজন নিজেদের মধ্যে খাদ্য, বাসস্থান ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস বিনিয়ম করবে। প্রাচীন যুগেও মানুষ বিনিময় প্রথার মাধ্যমে জিনিস কিনতো, সেসময় সমাজে কোনও অর্থ বা মুদ্রা ছিলনা, একে প্রাচীন কমিউনিজমও বলা চলে। আধুনিক কমিউনিজমের জন্ম হয় আঠারো ও উনিশ শতকে শিল্প বিপ্লবের সময়। সেসময় পশ্চিম ইউরোপে একশ্রেনীর মানুষ হঠাৎই প্রচুর অর্থবান হয়ে গিয়েছিল কিন্তু সমাজের বেশীরভাগ মানুষের কাছে তেমন অর্থ ছিলনা। ইউরোপে প্রচুর শিল্পকারখানা তৈরি হয়েছিল যাদের হাজার হাজার শ্রমিক কম বেতনে বাধ্য হয়ে কাজ করতো এবং মালিকপক্ষ তাদের শোষন করতো। কার্ল মার্ক্স এইসময়ে লক্ষ্য করে সমাজ দুটি শ্রেনীতে বিভক্ত হয়ে গেছে বিত্তবান ধনী সম্প্রদায় এবং অবহেলিত শ্রমিক শ্রেনী। তিনি ইউরোপে শ্রমিক শ্রেনীর অর্থাভাব, রোগে ভোগা খেয়াল করেন। এই জন্য কার্ল মার্ক্স তার বন্ধু অর্থনীতিবিদ ফ্রেডরিক এঙ্গলেসের সাথে যৌথভাবে ১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো লেখেন যেখানে তিনি পুঁজিবাদকে বাদ দিয়ে কমিউনিজম স্থাপনার কথা লেখেন। এখানে কার্ল মার্ক্স লেখে সমাজে কোনও শাসক শ্রেনী থাকবেনা, সবাই সমানাধিকার পাবে, কেউ ধনী গরীব থাকবেনা, কারও কাছে পৈতৃক সম্পত্তি থাকবেনা। এজন্য কার্ল মার্ক্সকে কমিউনিজমের জনকও বলা হয়। কিন্ত কার্ল মার্ক্স এই নীতি একটি কমিউনিস্ট দেশে কিভাবে প্রয়োগ করা হবে সেসম্পর্কে কিছু বলে যায়নি যার জন্য তার মতবাদ সফল হয়নি। বিংশ শতকে রাশিয়ান বিপ্লবী ভ্লাদিমির লেলিন কার্ল মার্ক্সের চিন্তাধারাকে সোভিয়েত রাশিয়াতে প্রয়োগের চেষ্টা করে। 

১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়ার সাধারন মানুষ রাশিয়ার সম্রাট জারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। ১৯২২ সালে ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে বিশ্বের প্রথম কমিউনিস্ট দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থাপনা হয়। লেনিন দেশে ভ্যানগার্ড দলের মাধ্যমে কমিউনিস্ট মতবাদ ছড়িয়ে দেয়। লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের অধিকাংশ জমি, কলকারখানার জাতীয় করন হয়, গরীব কৃষকদের জমি দেওয়া হয়, সাধারন মানুষকে বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্ত লেনিন দেশে সমস্ত বিরোধীদলকে হটিয়ে দিয়ে দেশে এক দল বিশিষ্ট সরকার তৈরি করে। লেনিনের এই মতবাদকে মার্ক্সিস্ট লনিনিস্ট মতবাদ বলা হয়। 

ভারতের সিপিআইএমএল দল এই লেনিনের মতবাদের উপরেই তৈরি হয়েছে। ভ্লাদিভসটকে লেনিনের মৃত্যুর পর জোসেফ স্তালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন শাসক হয়। জোসেফ স্তালিনের সময় কমিউনিজমের আসল চেহারা বিশ্বের সামনে আসে। জোসেফ স্তালিনের সময়ে দেশের কৃষিব্যবস্থা, শিল্প সরাসরি সরকারের হাতে চলে যায়। সেসময় সোভিয়েত মানুষদের জোরকরে কম পারিশ্রমিকে কাজ করানো হত। জোসেফ স্তালিন সোভিয়েত ইউনিয়নে বিরোধীশূন্য করার জন্য কয়েকলাখ মানুষকে হত্যা করে। জোসেফ স্তালিনের পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে বেশী খরচ করা হয় যার জন্য দেশে প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব দখা দিতে শুরু করে এবং দূর্নীতি বেড়ে। 

১৯৯০ সাল আসতে আসতে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়, যার জন্য ১৯৯১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কমিউনিস্ট দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। ১৯৪৯ সালে চীনেও মাও জেডং এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হয়। এই জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের পরে চীনকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কমিউনিস্ট দেশ বলা হয়। কিন্ত মাও জেডং এর সময়েও প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। মাও জেডং এর ভুল নীতির কারনে ভয়ানক দুর্ভিক্ষে ১৫ থেকে ৪৫ মিলিয়ন লোকের মৃত্যু হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে মাও জেডং কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল। এজন্য মাও জেডংকেও জোসেফ স্তালিনের থেকেও বড় ডিক্টেটর বলা হয়। 

মাওয়ের এই উগ্র কমিউনিজম নীতিকে মাওয়িজম বলা হয়। ভারতের নক্সালিজম এই মাওয়িজকেই অনুসরন করে। এজন্য এরা নিজেদেরকে মাওবাদী বলে। আজকের যে উন্নত চীনকে দেখা যায় তার ভীত তৈরি করেছিল প্রাক্তন চাইনিজ রাষ্ট্রপতি ড্যাং জিওপিং, যিনি কমিউনিজমের আদর্শ থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসে পুঁজিবাদী নীতি গ্রহন করে আধুনিক চীনের গঠন শুরু করেছিল। ১৯৬৫ সালে কিউবাতে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট দল ক্ষমতায় আসে। এরপরেই কিউবার ইতিহাসে সবচেয়ে কালো যুগের সূচনা হয়। কিউবা ফিদেল কাস্ত্রোর আসার আগে অর্থনৈতিক ভাবে মজবুত ছিল কিন্তু বর্তমানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বে কিউবার অবস্থান ১৭৫তম। 

কমিউনিজম উপর থেকে দেখলে মনে হবে অসাধারম নীতিগত আদর্শ কিন্ত কোনও দেশে কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় এলে কমিউনিজমের আসল কালোরূপ দেখা যায়। কমিউনিস্ট নেতাদের প্রথম লক্ষ্য থাকে বিরোধী শূন্য করা তা সে যেভাবেই হোক। বিরোধী শূন্য করতে গনহত্যা করতেও কমিউনিস্টরা পিছপা হয়না জোসেফ স্তালিন, মাও জেডং এর সবচেয়ে বড় উদাহারন। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কিউবা সহ যেসব দেশেই কমিউনিজম গেছে সেখানকার মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্পূর্ন নষ্ট হয়ে গেছে। কমিউনিজমের সবচেয়ে বড় দ্বিচারিতা হচ্ছে সমাজে শাসকশ্রেনী থাকবেনা কিন্তু বাস্তবে প্রত্যেকটি দেশের কমিউনিস্ট সরকার এক একটি ডিক্টেটর। কমিউনিজমে বলা হয় ধনী গরীব বলে কিছু থাকবেনা। এই হিসাবে একজন ব্যাক্তি পরিশ্রম করে, জ্ঞান অর্জন করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করলে তাকে সেই পয়সার অধিকাংশ সরকারকে দিয়ে দিতে হবে যাতে দেশে ভারসাম্য বজায় থাকে। একটি সমৃদ্ধশালী দেশ কমিউনিজমের কারনে পুরো ধ্বংস হয়ে গেছে যার সবচেয়ে বড় উদাহারন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবা। কমিউনিজম সেই ক্যান্সারের মতোন যা কোনও দেশে প্রবেশ করলে সেই দেশকে সম্পূর্ন ভাবে ধ্বংস করে দেয়। কোনও দেশ, কোনও জাতি, কোনও সমাজকো সম্পূর্ন রূপে পঙ্গু করে দিতে কমিউনিজমের কোনও বিকল্প নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *