কমিউনিসমের বিরুদ্ধে ২৭ কোটি বোম্বিং। ভিয়েতনাম থেকে কেন খালি হাতে ফিরেছিল আমেরিকা?
রাজেশ রায়:- যদি বলা হয় পৃথিবীর কোন দেশে সবচেয়ে বেশী বোম্ব ফেলা হয়েছে, তাহলে সবার প্রথমে আমাদের মাথায় আসে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর নাম ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া কিংবা আফগানিস্তান। কিন্তু সঠিক উত্তর এগুলোর কোনওটাই নয়। দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার একটি ছোট্ট দেশ লাওসে সবচেয়ে বেশী বোম্ব ফেলা হয়েছিল। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এই দেশ গুলো দক্ষিন এশিয়ান দেশ, আবার চীন, তাইওয়ান পূর্ব এশিয়ার দেশ। এসব দেশ গুলোর মাঝে লাওস, কম্বোডিয়া, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মতন দেশ অবস্থিত যাদের দক্ষিন পূর্ব এশিয়ান দেশ বলা হয়। দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দশটি দেশকে একত্রে আসিয়ান দেশ বলা হয়। এই লাওস সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
লাওসের জাতীয় পতাকায় তিনটি রং আছে লাল, নীল ও সাদা। লাল রং রক্তের প্রতীক। একসময় লাওস ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল, স্বাধীনতা লাভের জন্য এবং দেশের ভিতরে গৃহযুদ্ধের কারনে প্রচুর মানুষ মারা যায়, এই লাল রং তারই প্রতীক। নীল রং মিকং নদীর প্রতীক। দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী হল মিকং নদী যা দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে জল সরবরাহ করে। সাদা রং লাওসের মানুষের ঐক্যের প্রতীক, এছাড়াও মিকং নদীতে চাঁদের ছায়া পড়ে খুব সুন্দর দেখতে লাগে, এই সাদা রং তারও প্রতীক। লাওস একটি ল্যান্ড লকড দেশ মানে লাওসের সীমানা রয়েছে থাইল্যান্ড, মায়ানমার, চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার সাথে। লাওসকে অনেক জায়গায় লাও নামেও ডাকা হয়, তবে সরকারি ভাবে লাও পিপলস ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক বলা হয়। লাওসের আয়তন খুবই কম মাত্র ২,৩৬,৮০০ স্কোয়ার কিলোমিটার। বলা হয় আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে দক্ষিন চীন থেকে কিছু লোক এসে এখানে বসতি স্থাপন করেছিল যা তাই ভাষায় কথা বলত। লাওসের প্রধান ধর্ম হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম। তবে সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের আলাদা একটি ভার্সন রয়েছে। লাওসের প্রাচীন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম মিশে গিয়ে এই নতুন ভাগ তৈরি হয়েছে। লাওস একটি পার্বত্য অঞ্চল যুক্ত দেশ যার জন্য প্রাচীন কালে লাওসের লোকেরা পর্বতের পূজো করত। এখনও সেখানে বৌদ্ধ সাধুরা পর্বের পূজো করে। লাওসের প্রথম রাজা ফা নাগুমের দ্বারাই এখানে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার ঘটেছিল। লাওস নাম ফ্রান্স দিয়েছে কারন এখানে ফ্রান্সের রাজত্ব ছিল। তবে স্থানীয় অনেক মানুষই লাওস নাম পচ্ছন্দ করেনা তারা লাওসকে মুয়াং লাও বা প্যাথেট লাও বলে।
১৮৯৩ সালে ফ্রান্স লাওস দখল করে নেয়, ১৯৪৫ পর্যন্ত লাওস ফ্রান্সের অধীনেই ছিল। ফ্রান্স লাওসে তেমন কোন উন্নয়ন করেনি। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল, জাপান ফ্রান্সকে হারিয়ে লাওস দখল করে নেয়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর আবারও ১৯৪৬ সাল থেকে লাওসে ফ্রান্সের শাসন শুরু হয়। তবে তখন লাওসের মানুষ স্বাধীনতার দাবি করতে থাকে। ১৯৫০ সালে লাওসকে অর্ধেক স্বায়ত্ত শাসন দেয় ফ্রান্স। কিন্তু তাও লাওসের লোক পূর্ন স্বাধীনতা জন্য আন্দোলন করতে শুরু করে যার জন্য ১৯৫৪ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে লাওস স্বাধীন হয়। কিন্ত সেই বছরই লাওসের ভয়ানক গৃহযুদ্ধ শুর হয়ে যায়। লাওসে একদল লোক কমিউনিজমকে সমর্থন করত তারা মূলত উত্তর লাওসে থাকত এবং তাদের সংগঠনের নাম ছিল প্যাথেট লাও, আরেকদল কমিউনিজমের বিরোধী ফলে ভয়ানক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
লাওসের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় ১৯৬০ সাল। এবছর আমেরিকা লাওসের উপর ব্যাপক বোম্বিং করে। সেসময় ভিয়েতনামে আমেরিকার সাথে ভিয়েতনামীদের যুদ্ধ চলছিল। কমিউনিস্ট ভিয়েতনামীদের সাহায্য করছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। লাওস তাদের সাহায্য করত, অনেক ভিয়েতনামী যোদ্ধা লাওসে লুকিয়ে ছিল। সেজন্য আমেরিকা ব্যাপক বোম্বিং করে লাওসে যাতে প্রচুর নিরীহ লোকের মৃত্যু হয়েছিল। বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যত বোম্বিং হয়েছিল তার থেকেও বেশী বোম্বিং লাওসে হয়েছিল যার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বেশী বোম্বিং এ ক্ষতিগ্রস্থ দেশ লাওসকে বলা হয়। ১৯৬৪-৭৩ অবধি আমেরিকা এই ছোট্ট দেশে ২৭০ মিলিয়ন বোম্ব ফেলেছিল!! প্রথমে উত্তর লাওসে কমিউনিস্ট ঘাঁটিতে বোম্ব ফেলা হয় পরে পুরো লাওস জুড়েই বোম্বিং করা হয়। আমেরিকা লাওসের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনওদিন যুদ্ধ করেনি বরং আমেরিকান ইনটেলিজেন্স সংস্থা গোপন ভাবে এই মিশনের দায়িত্বে ছিল। এমনকী আমেরিকার সাধারন মানুষ ও মিডিয়ও জানতে পারেনি এব্যাপারে। রজার ওয়ার্নারের লেখা শ্যুটিং এট দি মুন বইয়ে এই পুরো ঘটনা সম্পর্কে লেখা আছে। লাওসে এখনও পুরোনো বোম্ব প্রচুর আছে। মানুষ এসব বোম্ব কেটে নৌকা করেছে, কেউ ঘরের বাইরে সাজিয়ে রেখেছে। আসলে সাধারন মানুষ এভাবেই সেই ভয়াবহ স্মৃতি মনে রাখে। ১৯৭৪ সাল আসতে আসতে আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধে হেরে যায় এবং ভিয়েতনাম, লাওস ছেড়ে চলে আসে। আমেরিকা চলে যেতেই ১৯৭৫ সালে লাওস দখল করে নেয় কমিউনিস্টরা। প্যাথেট লাও নামে সংগঠন নাম পাল্টে লাও পিপলস ফ্রন্ট নাম রাখে। তারা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে।
রাজা সাবাং ভাঠহানাকে সিংহাসনচ্যুত করে জেলে ভরে দেওয়া হয়, সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এরপর পুরো লাওসে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু কীছু বছরের মধ্যেই লাওসের কমিউনিস্ট শাসন ব্যাবস্থা পুরো ভেঙে পড়ে। ১৯৭৯ সালে লাওসের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে এবং দেশে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা যায়। লাওসের অনেক লোক বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে থাইল্যান্ডে শরনার্থী হয়ে চলে যায়। বাধ্য হয়ে লাওসের সরকার ১৯৮৬ সালে দেশে কমিউনিস্ট মডেল কীছুটা পরিবর্তন করে। ১৯৮৯ সালে লাওসে ভোট হয় যাতে কমিউনিস্ট দলই থেকে যায়। লাওস পিপিলস রেভোলিউশোনারি দল লাওসের ক্ষমতায় আসে। আজও লাওসে এই একটি দলই ক্ষমতায় আছে। আসলে চীনের মতোই কমিউনিস্ট দেশ হিসাবে লাওসেও একটি দলই আছে ক্ষমতায়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার সাথে সাথে বিশ্বের সামনে স্পষ্ট হয়ে কমিউনিস্ট মডেলের দুর্বলতা সম্পর্কে যার জন্য সেইসময় থেকেই বিশ্ব ক্যাপিটালিজমের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। ১৯৯৪ থেকে কমিউনিজম থেকে খানিকটা মুক্ত করে আশেপাশের দেশ গুলোর সাথে সম্পর্ক ভাল করা শুরু করে লাওস। যার ফলে মিকং নদীর উপর বন্ধুত্বের সেতু তৈরি হয় লাওস ও থাইল্যান্ডের মধ্যে। এই সেতুর নাম মিতাফাব সেতু যা ১.২ কিলোমিটার লম্বা। ১৯৯১ সালে এই সেতু তৈরির কাজ শুরু হয় এবং ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে এর নির্মানকাজ শেষ হয়। বানিজ্যিক কারনে এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ। ল্যান্ড লক দেশ হওয়ায় লাওস বানিজ্যিক ব্যাপারে থাইল্যান্ডের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল।
১৯৯৫ সাল থেকে আমেরিকা লাওসকে সাহায্য করতে শুরু করে। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাওসের সাথে স্বাভাবিক বানিজ্যিক সম্পর্ক শুরু করে আমেরিকা। ২০০৫ সালের এপ্রিলে বিশ্ব ব্যাঙ্ক লাওসের নাম থিয়াম ২ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির জন্য লোন দেয়। যদিও এই ড্যাম তৈরির বিরোধীতা স্থানীয় মানুষজনই করেছিল কারন এতে নাকী পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে সংঘর্ষযুক্ত দেশটিতে একটু ভালোদিন আসে। লাওস আসিয়ানের সদস্যও হয়। ২০১৬ সালে প্রথম কোন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি হিসাবে লাওসে যান বারাক ওবামা। তিনি তিন বছর ধরে প্রতি বছরে লাওসকে ৯০ মিলিয়ন ডলার দেবার ঘোষনা করেছিলেন কারন লাওসে এখনোও অনেক জায়গায় প্রচুর বোম্ব আছে, সেগুলো অনেক সময় বিস্ফোরন হয় এতে মানুষ মারাও যায়। তাই এইসব বোম্ব গুলোকে সরাবার জন্য আমেরিকা এই টাকা লাওসের জন্য ঘোষনা করেছিল।
আগেই বলা হয়েছে লাওস একটি পার্বত্যময় ভূমি। বিশেষকরে উত্তরাংশে ৯০০০ ফুট উঁচু পাহাড় আছে। লাওসের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় হচ্ছে ফৌবিয়া যা লাওসের জিয়াংখওয়াং প্রদেশের আনামেসে করডিলারেতে অবস্থিত। এখানে পর্যটকদের যাওয়া নিষেধ কারন এখানে অনেক বোম্ব রয়েছে এখনও। মিকং নদী বিশ্বের বারোতম এবং এশিয়ার সপ্তম দীর্ঘ নদী। বিশ্বের দীর্ঘতম নদী হচ্ছে মিশরের নীল নদ এবং এশিয়ার দীর্ঘতম নদী হচ্ছে ইয়াংতে নদী যা চীনে রয়েছে। চীন থেকে শুরু হয়ো মিকং নদী মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম হয়ে বয়ে গিয়েছে। মায়ানমার ও থাইল্যান্ড হয়ে মিকং নদী লওসের মধ্যে দিয়ে ১৫০০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়েছে। লাওসে চীনের প্রভাব রয়েছে সবচেয়ে বেশী তবে বর্তমানে লাওসে চীন বিরোধীতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ধীরে ধীরে এই মিকং নদীকে কেন্দ্র করে। চীন মিকং নদীর উপর অনেক বাঁধ তৈরি করছে যার উদ্দেশ্য চীনের যেসব প্রদেশে জল সরবরাহ কম সেসব জায়গায় জল সরবরাহ করা। এর ফলে লাওসে মিকং নদীর জল কমে যাচ্ছে যার বিরোধীতা করছে লাওস। লাওসের মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। দক্ষিন লাওসের ফু কাও পর্বতে ওয়াট ফৌ নামে এক প্রাচীন হিন্দু মন্দির আছে। এই মন্দিরে ভগবান শিবের পূজো হয়, পাহাড়ের উপর ঝর্না থেকে জল এই মন্দিরের ভিতরে থাকা শিবলিঙ্গে পড়ে। এই পুরো অঞ্চল পুনর্গঠনের কাজ ভারত সরকার করছে কারন এব্যাপারে ভারত সরকার ও লাওসের সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে। লাওসের মুদ্রার নাম লাও কিপ কিন্তু ভঙ্গুর অর্থনীতির কারনে এই মুদ্রা খুবই দুর্বল। ভারতের জন্য লাওস খুবই গুরুত্বপূর্ণ দেশ, বিশেষ করে চীনের বিরুদ্ধে। যার জন্য লাওস ও ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। লাওসে কৃষিকাজ প্রজেক্টের জন্য ভারত ৬৬ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে।