কাগজ শিল্প শুরু চীন থেকেই, তবে কিভাবে ভারতবর্ষের শুরু হল এর ব্যবহার?
এতদিন ধরে প্রচলিত মত ছিল কনস্টান্টিনোপলের পতনের পরই (১৪৫৩ খ্রিঃ) ইউরোপে মধ্যযুগের শেষ আর আধুনিক যুগের সূচনা। বরং বলা ভালো ইউরোপে কাগজের ব্যবহারের পর থেকেই নাকি মধ্যযুগের ইতি। যুক্তিও দিয়েছেন, সেই সাথে জানিয়েছেন ছাপার উপযোগী কালির আবিষ্কার ও ছাপাখানার গোড়ার কথাও। এই গ্রন্থটি আজ থেকে প্রায় ৯০ বছর আগে লেখা হলেও, আজও আমাদের ইতিহাসের প্রাথমিক জ্ঞানে যুগ বিভাজনে ঐ নগর পতনের রাজনৈতিক ঘটনাটাই প্রাধান্য পেয়ে আসছে।
প্রথমত, যদি কাগজের আবিষ্কারের একদম গোড়ার ইতিহাস বিস্তারিত ভাবে জানাতে হয়, তবে সে বিষয়ে মূল্যবান গবেষণা পাওয়া যাবে সিয়ান সুয়েন হুসেন–এর লেখায়।
দ্বিতীয়ত, প্রাচীন চিনের সেই পর্বের ইতিহাসে না গিয়েও বলা যায়, বারুদ ছাড়া তাদের দ্বিতীয় যে আবিষ্কার বাকি পৃথিবীর কাছে শ্রেষ্ঠত্ব আদায় করে নেয়, তা হল কাগজ, ছাপার কালি ও সর্বোপরি সাদা কাগজে কালো কালি দিয়ে লেখা বা ছাপানোর কৌশল। ভারতের যে ভুষোকালির ব্যবহার তা আদতে চিন থেকেই আগত। তবে যদি ভেবে থাকেন এই সব প্রযুক্তি চীন থেকে এখানে সরল পথে আগত হয়েছে, তাহলে সেটা যে ভুল তা বলতেই হবে। এগুলো এসেছিল ইসলামি শাসনের আগমনের সাথে এবং বহু পথ ঘুরে।
ভারতে কাগজ শিল্পের আগমন ও উৎপাদনের পদ্ধতি নিয়ে গত শতকের ছয়ের দশকে পি. কে. গোডে আলোচনা শুরু করেন। প্রায় একই সময়ে ইরফান হাবিব এই গবেষণায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন করেছেন, যা সেই সময় ভারতীয় কাগজের অতীত সম্পর্কে প্রাথমিক আগ্রহ তৈরি করে।
রাসায়নিক নিরীক্ষা ছাড়াই প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, ভারতবর্ষে প্রথম কাগজের নিদর্শন মেলে ১০৩০ সাল নাগাদ, সিন্ধ অঞ্চলের মনসুরায়। তবে, নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ত্রয়োদশ শতকে দিল্লিতে কাগজ তৈরির উল্লেখ রয়েছে। আমির খসরু (১২৫৩-১৩২৫) তার রচনায় কাগজকে সমসাময়িক শিল্পদ্রব্য বলে উল্লেখ করেছেন। তবে এই সময়ের কাগজের উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় খুব সামান্যই হতো। তাই হয়তো ব্যবহৃত কাগজকে ধুয়ে আবার ব্যবহারের উপযোগী করার কথা জানা যায়। গিয়াসউদ্দিন বলবনের শাসনকালে (১২৬৬ – ৮৭) তার একটি নির্দেশ বাতিল হওয়ায় সেই কাগজ পরিষ্কার করে পরবর্তী নির্দেশ লেখার কথা জানা যায়।
কাশ্মীরের সুলতান জয়নুল আবেদিন ও খোরাসানের শাসক আবু সাইদের মধ্যে যখন উপহার বিনিময় হয়, তার তালিকা দেখলে ভারতীয় কাগজের মান যে উন্নত ছিল, সে ধারণা স্পষ্ট হয়। সুলতান আবু সাইদ শ্রেষ্ঠ মানের আরবীয় ঘোড়া, উন্নত উট ইত্যাদি প্রদান করেন। বিনিময়ে সৌজন্য রক্ষার্থে কাশ্মীরের সুলতান জাফরান, কাগজ, সুগন্ধদ্রব্য, গোলাপজল, সিরকা (ভিনিগার), দামী শাল, কাঁচের বাটি প্রভৃতি স্থানীয় উৎকৃষ্ট জিনিসগুলি পাঠিয়েছিলেন।
চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগে কাগজ উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এমনকি দিল্লির মিষ্টি ব্যবসায়ীরা বাতিল কাগজ দিয়ে ঠোঙা বানিয়ে তাতে মিষ্টি বিক্রি করতো। সুলতানি শাসনের বিস্তারের ফলে কেবল দিল্লিতেই কাগজ উৎপাদন বেড়েছিল তাই নয়, সেই সাথে সাথে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তা ছড়িয়ে পরে। ১৪৩২ সালে চিনা পর্যটক মাহুন যখন বাংলায় এসেছিলেন, তখন গাছের বাকল দিয়ে তৈরি এক ধরনের সাদা কাগজের খুব প্রশংসা করেন। তার ভাষায় ‘হরিণের চামড়ার মত মোলায়েম’। সম্ভবত এই প্রযুক্তি আসে তিব্বত থেকে। তবে কেবলই গাছের ছাল দিয়ে যদি মণ্ড তৈরি করা হয়ে থাকে তবে এটাই তার প্রথম নিদর্শন।
কাগজ তৈরির মিল বা কারখানার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বাবরনামায়। বাবর তার এই আত্মজীবনীতে সমরখন্দের শহরতলীতে কাগজের কারখানার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। আসলে বিদ্যানুরাগী বাবরের কাছে তার ব্যবহৃত শ্রেষ্ঠ মানের কাগজ যেহেতু এই অঞ্চলেই তৈরি হতো তাই আলাদা করে এর কথা জানিয়েছেন।
তবে বাবরের প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগেই স্পেনের আল ঘরনতি (মৃঃ ১১৭০ সাল) লিখেছেন যে, মিশরের তৈরি কাগজের (কাগজ-ই-মিশরী) বাজার দখল করে নিয়েছে প্রথমে সমরখন্দ, পরবর্তীতে উত্তর আফ্রিকা (মাগরিব অঞ্চল)। আর বালাখে তৈরি কাগজের গুণমানের সাথে তুলনা চলে ইরাক, খোরাসান বা হিন্দ অঞ্চলের কাগজের।