ফিচার আর্টিকেল

একসময় এই ট্রেনের নাম থাকলেও এখন আর এই ট্রেনটির দেখা মেলে না

মানুষকে নির্দ্বিধায় পাখির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। মানুষ এবং পাখির মধ্যে পার্থক্য শুধু এইখানে যে পাখিদের দুটো ডানা থাকে আর মানুষদের তা থাকে না। কিন্তু পাখি যেমন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিমেষের মধ্যেই চলে যেতে পারে, মানুষও কিন্তু ঠিক তেমনটাই পারে। তবে এতে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব মানুষের নয়, বরং কৃতিত্ব আছে যানবাহনের। ব্রিটিশ আমলে ঘোড়ার গাড়ির খুব চল ছিল। আস্তে আস্তে সময়ের সাথে তা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। তারপর একটা সময় রিকশা খুব করে নজরে পড়তো। এখন কলকাতার অলিতে গলিতে হয়তো দুটো একটা রিক্সা নজরে পড়লেও পড়তে পারে। তবে মানুষের ভ্রমণ যাত্রায় সময় এবং অর্থের দিক দিয়ে সাশ্রয়ী যান হিসেবে রেলগাড়ি একমাত্র নাম করতে পেরেছে।

রেলগাড়ির যাত্রা শুরুর কথা বলতে গেলেই, প্রথমে মাথায় আসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পথের পাঁচালী’-এর কথা। ১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায়ের তত্ত্বাবধানে ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রটি প্রকাশ পেয়েছিল। এই চলচ্চিত্রের মধ্যে রেলগাড়িকে নিয়ে দেখানো এমন একটি দৃশ্য রয়েছে যা আজও মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। সেই সময় নতুন নতুন রেল গাড়ির যাত্রা শুরু হয়েছিল। আর সেই নতুন রেলগাড়ি দেখার জন্য ছোট্ট অপু তার দিদি দূর্গার সাথে এক দৌড়ে রেল লাইনের ধারে পৌঁছে গিয়েছিল সেই নতুন গাড়ি দেখার জন্য। তখন এইরকম কারেন্টের সাহায্যে ট্রেন চলতো না। চলতো কয়লার জ্বালানি দিয়ে আর সেই জ্বালানির ধোঁয়া বের করার জন্য ট্রেনের মাথায় একটা পাইপ ফিট করা থাকতো।

কিন্তু এই রেলগাড়ির যাত্রা কবে থেকে শুরু হয়েছিল জানেন? এবং কার উদ্যোগেই বা রেলগাড়ি এতো সাফল্য অর্জন করল? 

১৮৫৪ সালের ১৫ অগস্ট, প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ২৪ মাইলের রেললাইন ব্যবহৃত হয়। এরপর প্রথমে হাওড়া থেকে পাণ্ডুয়া, পরে ১৮৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাওড়া থেকে রানিগঞ্জ পর্যন্ত নিয়মিত ট্রেন চালু হয়। প্রথমে পণ্য পরিবহণের জন্য চালু হলেও অচিরেই আরও বহু রেললাইন বসে এবং মানুষের যাতায়াতের অঙ্গ হয়ে ওঠে রেলগাড়ি। দীনবন্ধু মিত্র, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণকামিনী দাসী, রূপচাঁদ পক্ষী থেকে শুরু করে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ বহু লেখকের লেখায় এই নতুন আশ্চর্য যানের উল্লেখ ছিল। তা থেকে জনজীবনে এই দ্রুতগতির ট্রেনগাড়ির ভূমিকা ও অভিঘাত কী বিপুল ছিল, আন্দাজ করা যায়।

স্ট্যান্ডার্ড গেজ বা ব্রড গেজ রেললাইন ছাড়াও অজস্র ছোট আকারের মিটার গেজ ও ন্যারো গেজ রেললাইন ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। বাংলায় ছোট রেললাইনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল ‘ম্যাকলিয়ড রাসেল অ্যান্ড কোম্পানি’ এবং ‘মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি’। স্বল্প ব্যয়ে, স্বল্প মূলধনে, কম পুঁজি ও গ্যারান্টি মানির সাহায্যে এই ফিডার লাইনগুলো বসানো সম্ভব ছিল বলে ১৮৯০ থেকে ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা পর্যন্ত এই প্রাইভেট কোম্পানির অজস্র ছোটো রেলগাড়ির স্বর্ণযুগ হয়ে ওঠে ভারতবর্ষ। এদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘মার্টিন রেল’। হাওড়া, হুগলির গ্রামাঞ্চলের বিরাট সংখ্যক মানুষের কাছে তো বটেই, পরবর্তী কালে বারাসত-বসিরহাট লাইট রেলওয়ে চালু করে তিনটি জেলার মানুষের কাছে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল এই লাইট রেলওয়ে। কিন্তু সময় সাথে সাথে এই লাইট রেলওয়ের বিলুপ্তি ঘটতে দেখা গেছে। তবে, আজও হয়তো হাওড়া, হুগলি, বারাসত, বসিরহাটের জায়গায় জায়গায় এই ন্যারো গেজ রেললাইনের অবশিষ্টাংশ কোথাও কোথাও রয়ে গিয়েছে, তার উপরে উঠেছে দোকানপাট, তৈরি হয়েছে বাস রুট। 

পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে ষাটের দশক অব্দি মার্টিন রেল চলেছিল। সত্তর দশকের গোড়ায় পৌঁছে আস্তে আস্তে উঠে যায় এই লাইট ট্রেন। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৫০-৫১ সালে চালু লাইট রেলওয়ের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে হাওড়া-আমতা, হাওড়া-শিয়াখালা এবং বারাসত-বসিরহাট লাইনের মার্টিন রেলওয়ের বিবরণ। ইংরেজ ব্যবসায়ী টমাস অ্যাকুইনাস মার্টিনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই রেল-পরিষেবা গড়ে তুলেছিলেন বাঙালি উদ্যোগপতি স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। 

১৮৯০ সালে তাঁরা গড়ে তোলেন তাঁদের কোম্পানি ‘মার্টিন অ্যান্ড কোং’। স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় যে শুধু রেললাইন তৈরি করার বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাই নয়, এমন অনেক নামিদামি স্থাপত্য রয়েছে যা স্যার রাজেন্দ্র মুখোপাধ্যায় নিজের হাতে তৈরি করে গিয়েছেন। রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের পরবর্তী সময়ে তার পুত্র বীরেন মুখোপাধ্যায়  এই ব্যবসার হাল নিজের হাতে ধরেন। বীরেন মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় ১৯৪৫ সালে মার্টিন কোম্পানির ট্রেনের জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ডিজেল ইঞ্জিন চালু হয়।

হাওড়া, হুগলি, চব্বিশ পরগনার বিস্তৃত অঞ্চলের প্রচুর মানুষজন কাজের সূত্রে কলকাতা যাতায়াত করেন, কিন্তু তাঁদের জন্য কোনও সস্তা সুগম যাতায়াত-ব্যবস্থা নেই। সেই অভাব দূর করতেই হাওড়া-আমতা লাইট রেলওয়ে (এইচ এ এল আর) এবং হাওড়া-শিয়াখালা লাইট রেলওয়ে (এইচ এস এল আর) গড়ে ওঠে। এরপর এই দুই প্রধান রেলপথের আরও শাখাপথ বেরিয়েছিল। মার্টিন রেলের অপর গুরুত্বপূর্ণ শাখা ছিল বারাসত-বসিরহাট লাইট রেলওয়ে (বি বি এল আর)। চব্বিশ পরগনা জেলার এই বর্ধিষ্ণু জনপদকে রেললাইনের মাধ্যমে যুক্ত করার এই প্রয়াস ছিল ঐতিহাসিক। 

১ ফেব্রুয়ারি ১৯০৫, বারাসত থেকে বসিরহাট, ২৬ মাইল দীর্ঘ এই রেলপথের সূচনা হয়। এরপর টাকি এবং ইছামতী-তীরবর্তী হাসনাবাদ পর্যন্ত দু’টি এক্সটেনশন লাইন খোলা হয়েছিল। যাত্রীর সংখ্যা অতি দ্রুত বৃদ্ধির কারণে ১৯০৮ সালে এই লাইনেই শ্যামবাজার শাখা খোলা হয়। গোটা উত্তর এবং পূর্ব কলকাতাকে ছুঁয়ে চলতো এই মার্টিন রেল। শ্যামবাজার থেকে শুরু হয়ে পাতিপুকুর, বাগুইআটি, হাতিয়ারা, রাজারহাট, লাঙলপোতা, হাড়োয়াখোল, খড়িবাড়ি, আমিনপুর, বেলেঘাটা জংশন হয়ে এই ট্রেন পৌঁছত হাসনাবাদ। বাষ্প-ইঞ্জিনচালিত পাঁচ কামরাবিশিষ্ট এই ধীরগতির ট্রেনে শ্যামবাজার থেকে বসিরহাট পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগত সাড়ে চার ঘণ্টা। কিন্তু খুব দ্রুত শ্যামবাজার থেকে বাস-পরিষেবা চালু হয়। 

১৯২৭ সালে মার্টিন কোম্পানির এই শ্যামবাজার-হাসনাবাদ লাইন বিক্রি করে দেওয়া হয় অন্য কোম্পানির কাছে। আরও পরে যাত্রীর সংখ্যা কমে যাওয়া, রেলপথ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় কারণে সেই বছরই কোম্পানি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। পঞ্চাশ বছর চলার পর ১ জুলাই ১৯৫৫ সালে এই লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শেষ ট্রেনটি যে দিন শ্যামবাজার থেকে ছাড়ে, সে দিন লাইনের দু’ধারে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত ছিল শেষ বিদায় জানাতে। 

১৯৫৫ সালের পর এই রেলপথ ভারত সরকার অধিগ্রহণ করে এবং ইস্টার্ন রেলের শিয়ালদহ ডিভিশনের অন্তর্গত হয়ে যায় এই লাইট রেললাইন। ১৯৬২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রেলমন্ত্রী জগজীবন রাম এই নতুন রেললাইনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *