সাদা তুষারাবৃত পর্বতের নাম মাউন্ট এভারেস্ট ঠিক কার নামে রাখা হয়েছিল তা কি জানেন?
প্রতিনিয়ত জীবনের এই একঘেয়েমি ভাব কাটাতে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন রকম শখ পালন করে থাকে। নিত্য দিনের কাজের ফাঁকে কোন মানুষ নিজের সাথে সময় কাটাতে ভালোবাসেন, আবার কোন মানুষ গাছপালা পরিচর্যা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, কেউ কেউ তাদের প্রিয় পোষ্যের সাথে খেলতে ব্যস্ত হয়ে যান, আবার অনেকেই আছেন যারা ঘুরতে খুব ভালোবাসেন। ভ্রমণের প্রসঙ্গেই অনেকগুলো কথা উঠে আসে, যেমন- অনেকেই আছেন যারা পরিবার,বন্ধু সবার সাথে ঘুরতে যেতে পছন্দ করেন, আবার অনেকেই আছেন যারা একা ঘুরতে যেতে পছন্দ করেন যেটাকে আমরা সোলো ট্রাভেলিং বলে থাকি। কেউ কেউ ট্রেকিংয়ে যেতে ভালোবাসেন।
প্রায়শই খবরে দেখা যায় অনেকেই একটা দল বেঁধে কোনো পাহাড়ের শিখরে উঠেছে এবং দেশের নাম উজ্জ্বল করেছে। আবার এই বিষয়ে অনেক মর্মান্তিক ঘটনাও নজরে পড়ে। পর্বত শৃঙ্গের নাম বললেই সবার প্রথমে মাথায় আসে মাউন্ট এভারেস্টের কথা। ভারতবর্ষের প্রথম মানুষ এবং সারা বিশ্বের মধ্যে ১৬ তম মানুষ যিনি মাউন্ট এভারেস্টে পৌঁছেছিলেন তিনি হলেন অবতার সিং চীমা। মাউন্ট এভারেস্টের নাম শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক সাদা তুষারাবৃত পর্বতের ছবি।
কিন্তু এই সাদা তুষারাবৃত পর্বতের নাম মাউন্ট এভারেস্ট ঠিক কার নামে রাখা হয়েছিল তা কি জানেন? আর এটি ঠিক কত নাম্বার শৃঙ্গ সেটা কি জানেন??
তুষারাবৃত হিমালয়ের আকর্ষণে বার বার আমরা তার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করি, তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। এই হিমালয়ের ভেতরে রয়েছে হাজার হাজার পর্বত শৃঙ্গ। প্রায় ২৭০০ কিলোমিটার বিস্তৃত হিমালয়ের জরিপের কাজ শুরু হয়ে ছিল ১৮৩৮ সাল থেকে। ব্রিটিশ সরকারের অধীনে প্রায় ১০০ বছর ধরে এই জরিপের কাজ চলেছিল। শুরুতে হিমালয়ের চূড়া গণনাই ছিল প্রথম কাজ। সেই উদ্দেশ্যেই শিখরকে শনাক্ত করে প্রত্যেকটিতে জরিপ নম্বর দেওয়া হয়েছিল। যে কারণে নামচে বোরওয়া থেকে গণনা শুরু হওয়ার ফলে শিখরের নম্বর ১ থেকে শুরু হয়ে ক্রমিক সংখ্যা অনুসারে পূর্ব থেকে পশ্চিমে গিয়েছে। এই ভাবে এগোতে এগোতে ১৮৫২ সালে ১৫ নম্বর শিখরটি শনাক্ত হওয়ার পর কর্নেল স্যর জর্জ এভারেস্ট অনুমান করেছিলেন, এটাই হতে পারে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। বিশিষ্ট গণিতবিদ, বঙ্গসন্তান রাধানাথ শিকদারও ছ’বার পর্যবেক্ষণ করার পর প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, ১৫ নং শিখরটিই বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গ, যাকে আমরা মাউন্ট এভারেস্ট নামে চিনি।
১৮৬৫ সালে ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল অ্যান্ড্রু ওয়া-র সুপারিশে রয়্যাল জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটি-র উদ্যোগে জর্জ এভারেস্ট-এর নামেই ১৫ নং শৃঙ্গের নাম রাখা হয় মাউন্ট এভারেস্ট। কিন্তু নেপালে এই শৃঙ্গটি ‘সাগরমাতা’ হিসেবে পরিচিত। আবার তিব্বতে এর নাম ‘চোমোলঙমা’। ১৮৫৪ সালে ১৫ নম্বর শৃঙ্গটির নাম ভারতীয় পুরাণ অনুযায়ী ‘গৌরীশঙ্কর’ রাখার প্রস্তাব উঠলেও তা সফল হয়নি।
সর্বোচ্চ শৃঙ্গের তকমা পাওয়ার পরই পর্বতারোহীদের মধ্যে শুরু হয় এই শৃঙ্গে আরোহণের প্রচেষ্টা। ১৯১৩ সালে প্রথম ব্রিটিশ সরকারের ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফি সোসাইটি ও ব্রিটিশ অ্যালপাইন ক্লাব-এর উদ্যোগে এভারেস্ট অভিযান শুরু করার জন্য আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয়েছিল তিব্বতের রাজা ত্রয়োদশ দলাই লামার কাছে। কিন্তু তখন সেই অনুমতি মেলেনি, কারণ শৃঙ্গটিকে পবিত্র শৃঙ্গ হিসাবে শ্রদ্ধা করা হত। ১৯২১ সালে দ্বিতীয় বার আবেদন করার পর দলাই লামার অনুমতি মেলে এবং সে বছরই প্রথম এভারেস্ট অভিযান শুরু হয়। কিন্তু সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেই ধ্বংসের বীজ রোপন থাকে সে কথা আমরা অনেকেই কম বেশি জানি। এই সর্বোচ্চ শৃঙ্গের তকমা পাওয়া মাউন্ট এভারেস্টের অভিযানে বহু মানুষ তাদের প্রাণ হারিয়েছেন। তেমনি দুজন মানুষ হলেন জর্জ ম্যালোরি ও আরভিন। তবে, এই অভিযানের সাফল্য স্পষ্ট নয়, কারণ জর্জ ম্যালোরি ও আরভিন দু’জনে অভিযানে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কিন্তু কেউ নিশ্চিত নন, পর্বতশৃঙ্গ জয় করতে যাওয়ার পথে তাঁরা মারা গেছেন না কি শৃঙ্গ জয় করে ফিরে আসার পথে দুর্ঘটনায় তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। অনেকেই জানেন না, জর্জ ম্যালোরি তাঁর স্ত্রীর একটা ছবি সঙ্গে নিয়ে অভিযানে গিয়েছিলেন এবং স্ত্রীকে বলেছিলেন, “যদি এই অভিযানে সাফল্য পাই, তা হলে তোমার ছবি পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে দেব।” ৭৫ বছর পর, ১৯৯৯ সালের ১ মে যখন জর্জ ম্যালোরির দেহটির সন্ধান পাওয়া যায়, তখন তাঁর কাছ থেকে স্ত্রীর ছবিটা কিন্তু পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ ধারণা করেন, হয়তো তাঁরা সফল হয়েছিলেন। নির্ভুল প্রমাণ না থাকার জন্য এই অভিযানের সাফল্য সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।
ওই যে কথায় আছে না, ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’ ঠিক তেমনি এভারেস্ট অভিযানে কিন্তু প্রথমেই সাফল্য আসেনি। তবুও কেউ হার মানেনি। শেষমেষ ১৯৫৩ সালের ২৯ শে মে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে এভারেস্ট অভিযানে সপ্তম বারের প্রচেষ্টায় স্যর জন হান্ট-এর নেতৃত্বে প্রথম সাফল্য আসে। শেরপা তেনজিং নোরগে ও এডমন্ড হিলারি এই দু’জনে এক সঙ্গে পা রাখলেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে। রচিত হল ইতিহাস। সময়টা ছিল সাড়ে ১১ টা। ২৯,০২৮ ফুট (৮,৮৪৮ মিটার) উচ্চতায় পৌঁছে গেলেন তাঁরা, গর্বিত হল ভারত। মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উড়ল ভারতের জাতীয় পতাকা।
এই যে মাউন্ট এভারেস্ট হোক বা যে কোনো পর্বতশৃঙ্গ নিজের দেশের নাম উজ্জ্বল করে সেখানে নিজের দেশের পতাকা গেঁথে আসার যে প্রচলন রয়েছে তা তো আমাদের জানা। কিন্তু প্রথমবার এভারেস্ট অভিযানে সাফল্য আসার পর যে পতাকা এভারেস্টের চূড়ায় গেঁথে দেওয়া হয়েছিল সেই পতাকাটি কার তৈরি করা জানেন?
রথীন্দ্রনাথ মিত্র নামে এক বঙ্গসন্তানের ভূমিকাও আছে এর পিছনে। তিনি তেনজিং-এর ইংরেজি কথোপকথন শিক্ষার মাস্টারমশাই ছিলেন। ১৯৩৮-এ তেনজিং যখন তিব্বত থেকে নেপাল হয়ে দার্জিলিং আসেন, তখন তিনি বুঝেছিলেন ব্রিটিশদের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায় ইংরেজিতে কথা বলা। তখনই তিনি দার্জিলিংবাসী রথীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছে যান ইংরেজিতে সাবলীল ভাবে কথা বলা শেখার জন্য। মিত্রবাবুর দার্জিলিং-এ দর্জির ব্যবসা ছিল। তিনি নিজের হাতে একটি জাতীয় পতাকা তৈরি করে তেনজিং-এর হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে ভারতমাতার সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই বঙ্গসন্তানের কৃতিত্বের কথা অনেকেই জানেন না।