ফিচার আর্টিকেল

প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাচীন ডাইনোসর হল ‘নিয়াসাসরাস’- পঞ্চম খণ্ড

পৃথিবীকে অনেকবারই হাঁটতে হয়েছিল গনবিলুপ্তির পথে। এইরকম করে এটা যুগের শেষ থেকে শুরু হয়েছে আবার আরেকটা নতুন যুগের পথ চলা। যার ফলে বদলে গিয়েছিল পৃথিবীর চিত্র, বিলুপ্তি হয়ে গিয়েছিল বহু প্রাণী এবং উদ্ভিত। ঠিক সেই চক্রে মেসোজোয়িক মহাযুগের প্রথম ধাপ ট্রায়াসিক যুগের সমাপ্তির পরই শুরু হয়েছিল এই মহাযুগের দ্বিতীয় ধাপ জুরাসিক যুগ।  এই সময় কেমন ছিল পৃথিবীর চিত্র? কেমন ছিল সেই সময়ের ভৌগলিক অবস্থা, জলবায়ু ? প্রাণী জগতের এবং উদ্ভিত জগতের উপর কিরকম প্রভাব পড়েছিল?  

জুরাসিক যুগের সূচনা হয়েছিল  প্রায়  দু’শ  মিলিয়ন বছর আগে এবং প্রায় ৫৪ মিলিয়ন বছরব্যাপী দীর্ঘ ছিল এই যুগ। এই যুগকে আবার ৩টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা- 

১. প্রাক জুরাসিক, যার সময়কাল ছিল ২০১.৩ মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে ১৭৪.১ মিলিয়ন বছর পূর্ব পর্যন্ত।
২. মধ্য জুরাসিক, যার সময়কাল ছিল ১৭৪.১ মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে ১৬৩.৫ মিলিয়ন বছর পূর্ব পর্যন্ত।
৩. শেষ জুরাসিক,  এর সময়কাল ছিল  ১৬৩.৫ মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে ১৪৫ মিলিয়ন বছর পূর্ব পর্যন্ত। 

এই তিনটি যুগ অর্থাৎ প্রাক জুরাসিক, মধ্য জুরাসিক এবং শেষ জুরাসিক যুগকেও আবার বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-

১) প্রাক জুরাসিকের ৪টি পর্যায় ভাগ করা যায়, যথা- হেটাঙ্গিয়ান, সিনেমুরিয়ান, প্রিন্সবেশিয়ান এবং টর্শিয়ান। 

২) মধ্য জুরাসিকেরও ৪টি পর্যায়  ভাগ করা যায়,  যথা- অ্যালেনিয়ান, বেজোশিয়ান, বেথোনিয়ান এবং ক্যালোভিয়ান। 

৩) শেষ জুরাসিকের ৩টি পর্যায় ভাগ করা যায়, যথা- অক্সফোর্ডিয়ান, কিমেরিডগিয়ান ও টিথোনিয়ান।

প্রাক জুরাসিক, মধ্য জুরাসিক এবং শেষ জুরাসিক যুগ এই তিনটি যুগকে যথাক্রমে বলা হত লায়াস, ডগার এবং মাম ।

ভৌগলিক অবস্থা

গোটা পৃথিবী জুড়ে বেশ ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল জুরাসিক যুগের শিলা। এর মধ্যে ছিল পাললিক, আগ্নেয় এবং রূপান্তরিত শিলা। সমুদ্রগর্ভে নিয়মিত পরিবর্তন এবং বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চলে যার জন্য জমতে থাকে পলি। সমুদ্রের গভীরে এখনও পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো পাললিক শিলাটি ছিল এই জুরাসিক যুগেরই। এই যুগে অনেক বেশি পরিমানে সচল ছিল টেকটোনিক প্লেটও। আর এর পরিমান পৃথিবীর যেসমস্ত জায়গায় বেশি ছিল সেই সমস্ত স্থানে লক্ষ্য করা গিয়েছে আগ্নেয় শিলারও ব্যাপক অস্তিত্ব। এছাড়াও সব মহাদেশেই সমুদ্রগর্ভে রূপান্তরিত শিলা মোটামুটি পাওয়া যায়, আবার ভূগর্ভ আকরিক আকারে স্থলে পাওয়া যায় এই শিলাকে।

এই যুগে মহাদেশ থেকে শুরু করে সমুদ্র এবং জীবজগতের মধ্যে দেখা গিয়েছিল ব্যাপক পরিবর্তন। ওই সময় ধীরে ধীরে প্যানজিয়া  ভাঙতে শুরু করেছিল। এই যুগে টেকটোনিক প্লেট অনেক বেশি পরিমানে সচল থাকার কারনে  অগ্ন্যুৎপাত হয় এবং জেগে ওঠে সমুদ্রগর্ভে দ্বীপ। জমতে শুরু করে একের পর এক  শিলার স্তর এবং স্বর্ণ, কয়লা, পেট্রোলিয়ামসহ অন্যান্য নানান প্রাকৃতিক সম্পদ উৎপাদন করে এই যুগ।

ট্রায়াসিক যুগের শেষের দিক থেকেই শুরু হয়েছিল প্যানজিয়ার ভাঙনের কর্মকাণ্ড যা চলেছিল গোটা জুরাসিক যুগ জুড়েই। প্রাক জুরাসিক যুগের সময়েও মোটামুটি প্যানজিয়ার অঞ্চলগুলো কাছাকাছিই ছিল। উত্তরাঞ্চলে লরেশিয়া, বর্তমানে উত্তর আমেরিকা ও ইউরেশিয়া ছিল এর অন্তর্ভুক্ত এবং দক্ষিণাঞ্চলে গন্ডোয়ানা, বর্তমানে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, ভারত, এন্টার্কটিকা ও অষ্ট্রেলিয়া ছিল এর অন্তর্ভুক্ত। আর এই বিশাল দুটি অঞ্চলকে বিভক্তি করেছিল টেথিস নামক এক উষ্ণপ্রধান পূর্ব-পশ্চিমব্যাপি বিস্তৃত সমুদ্রপথ।

জুরাসিক যুগে প্রচুর পরিমানে সামুদ্রিক চিড় দেখা গিয়েছিল উত্তর আমেরিকা ও ইউরেশিয়ার মধ্যে, উত্তর আমেরিকা ও গন্ডোয়ানার মধ্যেও,  এছাড়াও  ছড়িয়ে যেতে থাকে কেন্দ্রগুলো। সামুদ্রিক বেসিনের কারনে নিয়মিতভাবেই বন্যায় প্লাবিত হতে থাকে অঞ্চলগুলো। যার ফলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বর্জ্য, যেমন- লবণ, খনিজ তেল ইত্যাদি জমতে থাকে যা বর্তমান দিনে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। মহাদেশীয় ভাঙনলীলা গোটা জুরাসিক যুগ ধরে চলতে থাকে এবং ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যায় এন্টার্কটিকা, ভারত ও মাদাগাস্কার থেকে  আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা, জন্ম হয় ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ।

জলবায়ু

এই যুগে উৎপাদিত হওয়া বিভিন্ন ফসিল এবং খনিজ পদার্থের উপর নির্ভর করে আনুমানবিক একটা ধারনা করা যায় যে ওই সময় কেমন জলবায়ু ছিল। ওই সময় বেশ উষ্ণই ছিল পৃথিবী, এখনকার মতো সেই সময়ে মধ্যরেখার সাথে উত্তর এবং দক্ষিণ গোলার্ধের তাপমাত্রার ততটা পার্থক্যও ছিল না। যেমন লবণ সমৃদ্ধ অঞ্চলে শুষ্কতা বিরাজ করত ঠিক তেমনি কয়লা সমৃদ্ধ অঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাত হত। এছাড়াও প্যানগিয়ার পশ্চিমাংশ ছিল বেশ শুষ্ক এবং পূর্বাংশ বেশ আর্দ্র ছিল। উপরিভাগে সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল এবং সমুদ্রের গভীরের জলের তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। মধ্য জুরাসিক যুগে জলবায়ু ছিল বেশ ঠাণ্ডা তবে শেষ জুরাসিক যুগে জলবায়ু উষ্ণ ছিল। আবার জুরাসিক-ক্রিটেশাস সময়ে হঠাৎ করেই তাপমাত্রা কমে গিয়েছিল।  

বিজ্ঞানীরা এই শেষ জুরাসিক যুগে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাওয়ার কারনগুলি মধ্যে অন্যতম কারন হিসাবে দায়ী করেছিল অগ্ন্যুৎপাত এবং সাগরতলের ভাঙনকে। কারন এর জন্য বাতাসের বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রচুর পরিমানে কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং গ্রীন হাউজ গ্যাস যার ফলে বৃদ্ধি পেয়েছিল তাপমাত্রা। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে টেথিস সাগরেরও কিছুটা অবদান রেখেছে গোটা পৃথিবীতে উষ্ণমন্ডলীয় এলাকার জল ছড়িয়ে দিয়ে। সম্ভবত উষ্ণ তাপমাত্রা, সামুদ্রিক উপাদানের ঘনত্বের অভাব এবং বাতাসের প্রবাহের স্বল্প উপস্থিতি ইত্যাদি কারনের জন্য সমুদ্রের জলে স্রোত বেশ কম ছিল। পূর্বেই জানা গিয়েছে যে এই সময় বরফের কোন অস্তিস্ত ছিলনা। মূল কথা হল যে এই বিষয়ে কোন একটি কারনকে বেছে নেওয়াটা খুব দুষ্কর।

জুরাসিক বিলুপ্তি

পাঁচটি বৃহৎ গণবিলুপ্তির মধ্যে একটি ছিল জুরাসিক যুগের বিলুপ্তি। এই সময় প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল অর্ধেক সামুদ্রিক অমেরুদন্ডী প্রজাতি। এর প্রভাবে কি পরিমানে স্থলজ মেরুদন্ডী প্রাণী ও গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেই বিষয়ে খুব একটা স্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায়নি। তবে এটা স্পষ্ট যে এই যুগের শুরুতে এবং শেষের দুটো গণবিলুপ্তিতে সব থেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সামুদ্রিক প্রাণীরাই। প্রায় ৮৪% প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এই যুগে। এছাড়াও ব্র্যাকিওপডরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। এই বিলুপ্তির জন্য মূলত দায়ী করা হয় সমুদ্রে অক্সিজেনের অভাবকে। প্রাণীকূলকে  মধ্য জুরাসিক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল এর ধাক্কা সামলে ওঠার জন্য।

জুরাসিক জীবন

বর্তমান দিনে বিচরণ করা বহু জীবজন্তুর প্রথম আগমন ঘটেছিল এই জুরাসিক যুগের থেকেই, যার প্রমাণ রয়েছে জুরাসিক শিলার স্তরে। মধ্য জুরাসিকে সমুদ্রগর্ভে মলাস্ক এবং প্রবাল প্রাচীরের আধিক্য ছিল। এছাড়াও আধুনিক মাছের আধিক্যও ছিল। অ্যামোনিটস এবং অন্যান্য স্কুইড সদৃশ প্রাণীদের সাথে সহাবস্থান করত মাছেরা, এছাড়াও বৃহৎ সরীসৃপ ছিল। তবে বর্তমান দিনে কেউই টিকে নেই এই পৃথিবীর বুকে। স্থলজ গাছপালার মধ্যে জিমনোস্পার্মের প্রাচুর্য ছিল যারা সেই সময়ের বাস্তুসংস্থানকে নিয়ন্ত্রণ করত। ঠিক একইভাবে বর্তমান দিনে বিচরন করা প্রাণীদের আদিপুরুষ ছিল এই যুগের স্তন্যপায়ী, উভচর এবং সরীসৃপেরা, আবার এরা গ্রহণ করেছিল প্রাক্তন প্রাণীদের স্থান যারা  বিচরণ করত শেষ ট্রায়াসিক যুগে। এখনও পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো পাখির জীবাশ্মটি ছিল এই জুরাসিক যুগেরই। মূল কথা হল আমরা বর্তমান দিনে যেসমস্ত প্রাণী দেখতে পায় ওই একই গোত্রের প্রাণীরা বিচরন করত জুরাসিক যুগেও। তবে জুরাসিক যুগ এবং আধুনিক যুগের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য রয়েছে আর সেটি হল যে ওই যুগে ডাইনোসর  ছিল প্রাধান্য বিস্তারকারী প্রাণী। 

এই যুগে বিশাল এক সমুদ্রে মেরুদন্ডী প্রাণীদের গোত্র চষে বেড়াত। এই সময়ে প্রচুর পরিমানে প্রাচুর্য ছিল অস্থি ও তরুণাস্থিময় মাছেরা। আর ওই সময় সমুদ্রে সবথেকে বড় অস্থিময় মাছ ছিল।  এছাড়াও ছিল  বড় মাছ এবং সামুদ্রিক সরীসৃপও। এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হওয়া সবচাইতে বড় মাংসাশী সরীসৃপ হল প্লিসিওসর। এছাড়াও প্ল্যাংকটনের মধ্যে ভাসমান, এককোষী, আণুবীক্ষণিক প্রাণীরা ছিল, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কোকোলিথোফোরস এবং ফোরামিনিফের এই দুটি গ্রুপ। আবার কিছু বিশেষজ্ঞদের মতে, শেষ জুরাসিকে উদ্ভব ঘটেছিল ডায়াটমের যাদের আধিক্য ছিল ক্রিটেশাস যুগেও। তবে মলাস্ক ছিল সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের ওপরের স্তর।

এই যুগে বেশ বড় একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছিল  স্থলজ প্রাণীদের মধ্যে। শেষ ট্রায়াসিক যুগে প্রাধান্য ছিল সিনাপসিড ওবং থেরাপসিডদের যাদেরকে বর্তমান দিনে স্তন্যপায়ীদের আদিপুরুষ বলা যায়। এছাড়াও এদেরকে স্তন্যপায়ী সদৃশ সরীসৃপও বলা হত। কিন্তু এদের সংখ্যা জুরাসিক যুগের শুরুতে বেশ কমে যায়। তবে এই যুগে আধিক্য বেশি ছিল আর্কোসরাসদের (ডাইনোসর, টেরোসর, কুমির)। কিন্তু কেন পরিবেশ হঠাৎ ‘সিনাপসিড প্রধান’ থেকে ‘আর্কোসরাস প্রধান’ হয়ে উঠে ছিল সেই বিষয়টি স্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায়নি। 

এই গোটা জুরাসিক যুগে রাজত্ব করে গেছে টেরোসররা। এদের হাড়  হালকা এবং পাখার গঠনের জন্য তারা  উড়তে এবং ভাসতে সক্ষম ছিল। যেমন শেষ জুরাসিক যুগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল প্রচুর সামুদ্রিক অমেরুদন্ডী প্রাণী,  ঠিক তেমনি প্রচুর স্থলজ মেরুদন্ডী প্রাণিরাও হারিয়ে ছিল তাদের বৈচিত্র্য। তবে এর পিছনে ঠিক কি কারন রয়েছে সেটা জানা সম্ভব হয় নি প্রয়োজনীয় তথ্য না থাকার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *