ফিচার আর্টিকেল

কোনও চিহ্ন না রেখেই পৃথিবীর বুক থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে অনেক প্রজাতির ডাইনোসর- দ্বিতীয় পর্ব

প্রায় সাড়ে চারশো কোটি বছর পেরিয়েছে আমাদের এই পৃথিবী। এই সুদীর্ঘ  সময়ের ব্যাপ্তিতে বহু পরিবর্তনের মধ্য থেকে যেতে হয়েছে পৃথিবীকে। শুধু পরিবর্তন নয় পৃথিবীকে অনেকবারই হাঁটতে হয়েছিল গনবিলুপ্তির পথে। এই ধ্বংসের জোয়ারে তলিয়ে গিয়েছিল অনেক যুগ। যার ফলে একসময়ে আমাদের এই পৃথিবীর বুকে বিচরন করা  কত শত কোটি প্রকারের জীবজন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। আর এই সমস্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া প্রাণীদের মধ্যে আমাদের মাথায় সবার প্রথমে যেই প্রাণীটির নাম আসে সেটি হল ডাইনোসর। আর সেটা হবে না-ই বা কেন!  প্রাগৈতিহাসিক যতটা ডাইনোসরের ওপর গবেষণা করেছে বোধ হয় আর কোনো প্রাণীর ওপর এত গবেষণা করা হয়নি। এছাড়াও এত বইপত্র, এত ডকুমেন্টারি এবং সিনেমাও তৈরি হয়নি, ডাইনোসরের ওপর যতটা হয়েছে ।

‘Dinosaur’ শব্দটি সর্বপ্রথম ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ অ্যানাটমিস্ট রিচার্ড ওয়েন ব্যবহার করেছিলেন। ডাইনোসর শব্দটি  দুটি শব্দের সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে, একটি হল গ্রীক শব্দ deinos যার অর্থ হল  ভয়ংকর এবং অপরটি হল sauras  যার অর্থ হল গিরগিটি। একে বাংলায় ‘ভয়ংকর গিরগিটি’ বা ‘ভয়ংকর সরীসৃপ’ বলা যায়। পূর্বে ডাইনোসরের পায়ের ছাপ এবং হাড়কে মনে করা হত ড্রাগন কিংবা লোপ পাওয়া গিরগিটির শরীরের জীবাশ্ম। তবে রিচার্ড ওয়েন সর্বপ্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে এই  প্রকান্ড হাড় এমন কোনো প্রাণীর যারা বহু বছর পূর্বে এই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, এবং এরা নিশ্চয়ই গিরগিটি থেকে আলাদা। ওয়েনের প্রকাশিত করা এ তথ্য রীতিমতো  উত্তেজনা ফেলে দিয়েছিল।  যার ফলে ডাইনোসর নিয়ে উন্মাদনা শুরু হয়ে যায় লন্ডনে। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে লাইফ-সাইজ ডাইনোসরের মডেল হাইড পার্কের ক্রিস্টাল প্যালেসে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়।

ব্যাপ্তিকাল ও গঠন

ঠিক কত বছর ছিল ডাইনোসরের ব্যাপ্তিকাল? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন একটি বিষয়। প্রায় দুই মিলিয়ন অর্থাৎ কুড়ি লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীতে মানুষ বসবাস করছে এবং পৃথিবীতে অন্তত ১৮০ মিলিয়ন বছর ধরে রাজত্ব করেছে ডাইনোসর। কিন্তু কতটা যে দীর্ঘ ছিল এই সময়টা তা কল্পনা করাটা আমাদের পক্ষে খুবই দুষ্কর। তবে যদি মানবজাতির বয়স এক মাস ধরা হয় সেই হিসাবে অনুযায়ী তুলনা করলে ডাইনোসরের বয়স প্রায় সাড়ে সাত বছর বলা যায়। আর এই সুদীর্ঘ সময়ে পৃথিবীকে বহু উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। এই উত্থান-পতনের কারনে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে বহু প্রজাতি তবে থেমে যায় নি এই উত্থান-পতনের চক্র। একটি প্রজাতির বিলুপ্তির পর বিবর্তন ঘটেছে নতুন আরেক প্রজাতির যার জন্য সময় লেগেছে আরও কোটি বছর। হয়ত একই সময়ে সব প্রজাতির ডাইনোসর বিচরণও করেনি। ঠিক কত প্রজাতির ডাইনোসর পৃথিবীতে বিচরন করেছে তা বিজ্ঞানীরা জানেনও না, এখন পর্যন্ত তাদের গননা করা ডাইনোসরের প্রজাতির সংখ্যা হল ৭০০, তবে সঠিক হিসেবটা কি তা হয়ত অজানাই থেকে যাবে চিরকাল। হয়ত এমন অনেক প্রজাতির ডাইনোসর ছিল যারা কোনো চিহ্ন না রেখেই অদৃশ্য হয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে। পৃথিবীর কোল থেকে শেষ জীবন্ত ডাইনোসরটিও বিলুপ্ত হয়ে গেছে আজ থেকে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে, যা ছিল গোটা মানবজাতির বয়সের তিনগুণেরও বেশি। 

তবে কাজটা যতই কঠিন হোক না কেন, কখনই থেকে যায়নি বিজ্ঞানীরা। মানুষের মধ্যে অজানা বিষয়কে জানার এই তীব্র আকাঙ্খা এগিয়ে নিয়ে গেছে পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতাকে। শুরুর দিকে ডাইনোসরের তেমন জীবাশ্ম ছিল না বিশেষজ্ঞদের কাছে, এমনকি প্রাণীগুলোর চেহারা সম্পর্কেও তেমন সঠিক কোন ধারণাও ছিল না। যেমন ঘটেছিল ওয়েন ইগুয়ানোডনের ক্ষেত্রে অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা ধারনা করেছিলেন যে এই প্রাণীটি ৯ মিটার লম্বা, জলহস্তির মতো বিশাল আকার এবং নাকের ডগায় ছোট ও ধারালো শিং ছিল। তবে অর্ধশতক পরে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে আসলে ক্যাঙারুর মতো দেখতে ছিল ইগুয়ানোডন। পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত হয়েছিল প্রচুর জীবাশ্ম। যার ফলে প্রচুর তথ্যোদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল বিজ্ঞানীরাও যেমন ডাইনোসরের বিবর্তন, তাদের আচার আচরণ এবং বিলুপ্তি সম্পর্কে ইত্যাদি। 

১৮৮৭ সালে  ডাইনোসরের নিতম্বের গঠন অনুসারে ইংরেজ জীববিজ্ঞানী এইচ. জি. সেলি এদেরকে দুটি প্রধান গ্রুপে বিভক্ত করেছে। যথা- 

1.  সরিসচিয়ান্স (Lizard hipped)
2. ওর্নিথিসচিয়ান্স (Bird hipped)

আবার এই দুটো গ্রুপকেও দুটো করে সাব গ্রুপে বিভক্ত করা হয়েছে।

1. সরিসচিয়ান্সদের দুটো সাব গ্রুপ হল-

I)  সরোপডোমর্ফা যাকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।  একটি হল প্রোসরোপড এবং অপরটি হল সরোপড। 

II)  ‘থেরোপড’ এই গ্রুপকেও দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি হল  সেরাটোসরিয়া এবং অপরটি হল টেটানরি।  

2. ওর্নিথিসচিয়ান্সদের দুটো সাব গ্রুপ হল-

I)  ‘সেরাপড’ এই গ্রুপকে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-  অর্নিথোপড, প্যাকিসেফালোসরিয়া এবং সেরাটোপসিয়া।

II)   ‘থাইরিওফোরা’ এই গ্রুপকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি হল স্টেগোসরিয়া এবং অপরটি হল অ্যাঙ্কিলোসরিয়া। 

বিজ্ঞানীরা Bird hipped বলতে বুঝিয়েছেন যেসমস্ত ডাইনোসরদের নিতম্বের গঠন আধুনিক আমলের পাখির মতো ছিল তাদেরকে। এদের Pubic bone ছিল এবং বেশিরভাগই ছিল ওর্নিথিসচিয়ান্সদের গোত্রের অন্তর্ভুক্ত, বিশেষ করে প্রথমদিকের ডাইনোসররা।

Lizard hipped ডাইনোসরদের ক্ষেত্রে  Pubic bone ছিল তবে সেটা  সামনের দিকে ঠেলে ওঠা ছিল। তবে মজার বিষয়টি ছিল যে পাখি কিন্তু Lizard hipped ডাইনোসরদের বংশধর, তাদের শুধু Pelvic bone এর গঠনটা অন্যরকম ছিল।

সকল ডাইনোসররা ছিল সরীসৃপ, কিন্তু  সকল সরীসৃপই কিন্তু ডাইনোসর ছিল না। ‘আর্কোসরাস’ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল ডাইনোসররা। এরা সবাই ডিম পাড়তে সক্ষম ছিল। এদের মধ্যে অনেকে ঠান্ডা আবহাওয়াতেও চলাফেরা করতে সক্ষম ছিল। এছাড়াও ডাইনোসররা জলে এবং  ডাঙায় অর্থাৎ উভয় স্থানেই বিচরণ করত। আর্কোসরাসদের মধ্যে আরও ছিল টেরোসর (উড়ন্ত সরীসৃপ), কুমির এবং পাখি।

ডাইনোসরের আকৃতি

কেমন ছিল ডাইনোসরের আকৃতি? এই  সম্পর্কে  বিজ্ঞানীরা মোটামুটি তথ্য আবিষ্কার করেছেন এদের হাড় এবং দাঁত থেকে। তবে কিরকম ছিল এদের গায়ের চামড়া সেই বিষয়ে বলাটা ছিল খুব মুশকিল কারন এদের চামড়া পচে মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল। তবে ডাইনোসর নিয়ে প্রচুর গবেষণা করার পরে ভাষ্কর স্টিফেন জেরকাস এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে ডাইনোসরদের গায়ের চামড়া মসৃণ ছিল না, আঁশযুক্ত এবং অনেক গোটা ছিল এদের। এছাড়াও এদের গায়ের রং উজ্জ্বল ছিল।      

আকারের দিক থেকে একেকটি ডাইনোসর  একেকরকমের ছিল। এদের মধ্যে কোন কোন ডাইনোসরের আকার ছিল বিশাল, তবে কতোটা বিশাল ছিল এদের আকার?  জীবাশ্মবিদ ডেভিড গিলেট ৪৩ মিটার লম্বা সিসমোসরাস নামে এক সরোপডের কথা বলেছেন। যখন এই বিশাল আকৃতির ডাইনোসর হাঁটত তখন তাদের প্রতি পদক্ষেপে যেন ছোটখাট ভূ-কম্পনের সৃষ্টি হত। গিলেট বলেছিলেন যে, “এর ভাই-ব্রাদ্ররা সম্ভবত এর চেয়েও বিশাল ছিল।

ডাইনোসরের ডিম

অন্যান্য সমস্ত সরীসৃপদের মতোই ডিম পেড়ে বংশবৃদ্ধি করত ডাইনোসরও। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল ডাইনোসরের ডিম। সেই থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ২২০টি ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ এ নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে।       

মূলত দু’ধরনের ছিল ডাইনোসরের ডিমের আকৃতি। প্রথমদিকে ডাইনোসরদের ডিমের আকৃতি ছিল গোল এবং একসাথে তারা ২০ থেকে ৩০টি ডিম পাড়ত। ওর্নিথিসচিয়ান্স গোত্রের অন্তর্গত ছিল এই ধরণের ডিম পাড়া ডাইনোসররা। এভাবে আধুনিক সরীসৃপদের ডিম পাড়তে দেখা যায়। পরবর্তীতে বিবর্তনের মাধ্যমে কিছুটা পাল্টে গিয়েছিল  ডিমের আকৃতি। সরিসচিয়ান্সদের অন্তর্গত কিছু প্রজাতির ডাইনোসর (যেমন- ওভির‍্যাপ্টোসরাস) একটু লম্বাটে আকৃতির ডিম পাড়তে শুরু করে। এই ধরনের ডিমের দু’পাশ কিছুটা সরু এবং এরা একসাথে ৩০-৪০টি ডিম পাড়ত। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, এরাই সরীসৃপ হতে পাখিদের বিবর্তনের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেছে।  

ভূতাত্ত্বিক পর্যায় 

বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর উৎপত্তিকালে বয়সের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীকে ৪টি মহাযুগে বিভক্ত করেছেন। যথা-  প্রিক্যামব্রিয়ান, প্যালিয়োজোয়িক, মেসোজোয়িক এবং সিনোজোয়িক। এদের মধ্যে মেসোজোয়িক মহাযুগকে সরীসৃপের যুগ বলা হয়। তবে এটাকে আবার ডাইনোসরদের যুগও বলা যেতে পারে। কারন প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে থেকে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে পর্যন্ত ছিল এর ব্যাপ্তি, অর্থাৎ প্রায় ১৮৫ মিলিয়ন বছর। মেসোজোয়িক মহাযুগকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা-

১. ট্রায়াসিক যুগ যার ব্যাপ্তিকাল ছিল ৫১ মিলিয়ন বছর।
২. জুরাসিক যুগ যার ব্যাপ্তিকাল ছিল ৫৪ মিলিয়ন বছর।
৩. ক্রিটেশাস যুগ এর ব্যাপ্তিকাল ছিল ৮০ মিলিয়ন বছর।

পৃথিবীকে অনেকবারই হাঁটতে হয়েছিল গনবিলুপ্তির পথে। এইরকম করে এটা যুগের শেষ থেকে শুরু হয়েছে আবার আরেকটা নতুন যুগের পথ চলা।  ঠিক সেই রকমই মেসোজোয়িক মহাযুগের সূচনার ঠিক পূর্বের যুগ পার্মিয়ান যুগ ছিল। এই যুগে পৃথিবীকে সাক্ষী হতে হয়েছিল অন্যতম এক গণবিলুপ্তি বা Mass Extinction-এর। বিজ্ঞানীদের মত অনুসারে, এখন পর্যন্ত পৃথিবীকে পাঁচটি বড় বড় বিলুপ্তির সাক্ষী হতে হয়েছে যার ফলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল সমস্ত প্রাণীকূল। আর এই গণবিলুপ্তি গুলির মধ্যে একটি ছিল পার্মিয়ান যুগের বিলুপ্তি। ভাবতে অদ্ভুত লাগলেও এটাই সত্যি ছিল যে এই যুগে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল ৯৫% জলজ এবং ৭০% স্থলজ প্রজাতি। অবশ্য এতে কারোর কিছুই করার ছিল না। পৃথিবী যে নিজেকে প্রস্তুত করছিল, টিকে থাকার বিচারে, তার সবচেয়ে সফল প্রাণীদের আগমনের জন্য! 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *