কাগজ, কাপড় নাকি প্লাস্টিক! কোন ধরনের ব্যাগ ব্যবহার করবেন? – দ্বিতীয় খণ্ড
পলিথিন, কাগজ নাকি কাপড়- কীসের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার করবেন?- প্রথম খণ্ড
কাপড়ের ব্যাগ বা টোট ব্যাগ
কাপড়ের তৈরি ব্যাগ নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানান ধরনের মতামত। একপক্ষ মনে করে যে প্রচলিত সকল ক্যারিয়ার ব্যাগের মধ্যে কাপড়ের তৈরি ব্যাগ হল সর্বোত্তম পরিবেশ-বান্ধব। আবার অপরপক্ষের মানুষজন এই ধারণার বিরোধিতা করে থাকেন। তাদের মত অনুযায়ী, এই ধরনের ব্যাগ উৎপাদনে অধিক মাত্রায় কার্বন ফুটপ্রিন্ট থাকে যা আমাদের পরিবেশের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে থাকে। তাহলে প্রশ্ন হল যে এই বিবৃতিগুলির মধ্যে কোনটি ঠিক?
এই ব্যাগগুলো অন্যান্য প্রচলিত ক্যারিয়ার ব্যাগের চেয়ে সর্বাধিক দৃঢ় এবং টেকসই প্রকৃতির। সেই জন্য এই ব্যাগগুলো একাধিকবার ব্যবহার করা সম্ভব। তবে এই ব্যাগগুলি উৎপাদন করা খরচ সাপেক্ষ অর্থাৎ জমি থেকে এটি উৎপাদনে ব্যবহৃত ফসলের চাষ থেকে শুরু করে তৈরি করা ব্যাগ পরিবহন করা পর্যন্ত অধিক পরিমাণ শক্তি এবং অর্থ খরচ হয়। এটি উৎপাদনে জন্য যেসমস্ত কাঁচামাল অর্থাৎ ফসল ব্যবহার করা হয় তার মাত্র ৩৩ শতাংশ জমি থেকে কাটার পরে ব্যবহারযোগ্য থাকে।
এর পাশাপাশি ওয়াশিং, ব্লিচিং, ডাইং, প্রিন্টিং এবং অন্যান্য প্রক্রিয়া করার জন্য প্রচুর পরিমাণে জল এবং বিদ্যুৎ খরচ হয়। ড্যানিশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাগুলোতে বলা হয়েছে যে প্রচলিত সকল ব্যাগের চেয়ে সুতির টোট এবং কাপড়ের ব্যাগ তৈরি করতে অধিক শক্তি খরচ হয়। সেইজন্য বলা যায় যে এগুলো পরিবেশের উপর সর্বাধিক চাপ সৃষ্টি করে থাকে। এছাড়াও এগুলো পুনর্ব্যবহার করা খুব কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। ২০১৭ সালে কেবলমাত্র ১৫.৩ শতাংশ পুনর্ব্যবহৃত করা হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত টেক্সটাইলে।
যেসমস্ত ব্যাগ জৈব কটন দিয়ে তৈরি করা হয় যেগুলি কীটনাশক ছাড়াই জন্মায়, যা পরিবেশের জন্য আরও ক্ষতিকারক। ফলনের দিক থেকে বিচার করলে প্রচলিত তুলার ফলনের চেয়ে জৈব কটনে ফলন ৩০ শতাংশ কম। সেক্ষেত্রে যদি প্রচলিত কটনের সমান পরিমাণ উৎপাদন করতে হয় তাহলে এদের ৩০ শতাংশ বেশি জল এবং জমি প্রয়োজন পড়বে।
কাগজের ব্যাগ
কাগজের তৈরি ব্যাগ নিয়ে রয়েছে নানান বিতর্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাগজের তৈরি ব্যাগের জনপ্রিয়তা থাকলেও ১৯৭০ এর দশকে যুক্তরাজ্যের বাজারে কমে গিয়েছিল কাগজ দিয়ে তৈরি ব্যাগের জনপ্রিয়তা। তার কারণ হল যে প্লাস্টিক ব্যাগকে কাগজের তৈরি ব্যাগের থেকে আরও বেশি টেকসই উপাদান হিসেবে দেখা হত। যুক্তরাজ্যের এক সমীক্ষা অনুসারে,পরিবেশগত ফুটপ্রিন্ট শোষণের উপর ভিত্তি করে একটি কাগজের ব্যাগকে কমপক্ষে চারবার পুনরায় ব্যবহার করা দরকার।
কাগজ দিয়ে ব্যাগ উৎপাদন করতে গেলে বেশি গাছ কেটে ফেলার দরকার হয়। কারণ বন থেকে সংগ্রহ করা হয় কাগজের ব্যাগ তৈরিতে ব্যবহৃত সকল উপাদান। প্রতিবছর ১০ মিলিয়নের বেশি কাগজের ব্যাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহার করা হয়, এর জন্য ১৪ মিলিয়ন গাছ কাটা দরকার হয়। এই বৃক্ষ কাটার ফলে পরিবেশে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
এই ব্যাগ তৈরি করার জন্য কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি এটি ব্যয়সাপেক্ষ কারণ উৎপাদনের জন্য খরচের তালিকায় যুক্ত হয় প্রয়োজনীয় জলের খরচ এবং কাঁচামাল বৃদ্ধির জন্য সার ব্যবহারের মতো জিনিস। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড অ্যাসেম্বলির গবেষণাপত্র অনুসারে একটি প্লাস্টিকের তৈরি ব্যাগের উৎপাদন প্রক্রিয়াটি থেকে একটি কাগজের ব্যাগ তৈরি করতে উচ্চ ঘনত্বের বিষাক্ত রাসায়নিক উৎপাদন হয়। এমন কি কাঁচামাল উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গাছ চাষের জন্য যে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় তা আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে সৃষ্টি হয় অম্লীয় বৃষ্টিপাত যা বিভিন্ন জলাশয়ের জলের সঙ্গে মিশে জল দূষণ বৃদ্ধি করে।
একটি প্লাস্টিকের ক্যারিয়ার তৈরি করার জন্য যে পরিমাণ জল প্রয়োজন হয় তার থেকে প্রায় ৪ গুণ বেশি জল প্রয়োজন হয় একটি কাগজের ব্যাগ তৈরি করতে। এমনকি টেকসই এর দিক থেকে বিচার করা হলে অন্যান্য ধরনের ব্যাগের তুলনায় কাগজের ব্যাগগুলো কম টেকসই। সেক্ষেত্রে যদি গ্রাহকদের ঘন ঘন তাদের কাগজের ব্যাগগুলো পরিবর্তন করতে হয় তাহলে তা পরিবেশের ওপর মারাত্বক চাপ তৈরি করবে।
কাগজের ব্যাগের স্থায়িত্ব কম এটা যে রকম ঠিক তেমনি প্লাস্টিকের তুলনায় এটি অনেক দ্রুত পচে যায় এবং কাগজের ব্যাগ ব্যাপকভাবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য। এদিকে প্লাস্টিকের ব্যাগগুলো প্রায় ৪০০-১,০০০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায় পচার জন্য। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড অ্যাসেম্বলির থেকে ২০১১ সালে প্রকাশিত হওয়া একটি গবেষণাপত্র বলা হয়েছিল যে, ,“একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ তৈরিতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয় তার থেকে চারগুণ বেশি শক্তি খরচ হয় একটি কাগজের ব্যাগ তৈরি করতে”। এছাড়াও প্লাস্টিকের ব্যাগের থেকে কাগজের ব্যাগের ওজন বেশি হওয়ার কারনে পরিবহনের জন্য বেশি পরিমাণে শক্তির প্রয়োজন হয়। তাই কাগজের ব্যাগের পরিবহন খরচ তুলনামূলক অনেক বেশি।
পলিথিন বা কাপড়ের ব্যাগের মতো এইধরনের ব্যাগ প্রতিরোধী না হলেও এর একটি ইতিবাচক দিক আছে সেটি হল যে এই ব্যাগগুলি অতি সহজেই মাটির সাথে মিশে যেতে পারে। সেই জন্য বাগানে সার হিসেবে এগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে। শুধু কাগজ নয় এছাড়াও ব্যাপকভাবে পুনর্ব্যবহৃত করা হয় যা এই ব্যাগ ব্যবহার করার স্বপক্ষে একটি যুক্তি হতে পারে।
কোন ধরনের ব্যাগ ব্যবহার করবেন
গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, একটি প্লাস্টিকের ব্যাগের পরিবর্তে একটি কাগজের ব্যাগ কমপক্ষে তিনবার পুনর্ব্যবহার ব্যবহার করতে হবে। আবার আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হল যে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগের পরিবর্তে একটি কাপড়ের ব্যাগ সর্বাধিক সংখ্যক ১৩১ বার পুনর্ব্যবহার করা দরকার। এছাড়াও যে ফসল ব্যবহৃত হয় কাপড়ের ব্যাগ উৎপাদন করতে তার জন্য উৎপাদনে নিবিড় পরিচর্যার করার প্রয়োজন হয় যা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় এর উৎপাদন খরচকে।
টেকসই এর দিক থেকে বিচার করলে প্লাস্টিকের ব্যাগের মতো ওতটা টেকসই নয় কাগজের ব্যাগ। কাগজের ব্যাগ ছিড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, বিশেষ করে কোনো কারণে যদি জলে ভিজে যায়। এর স্থায়িত্ব কম থাকার জন্য একটি কাগজের ব্যগকে নিয়মিত প্রয়োজনীয় সংখ্যকবার পুনরায় ব্যবহার করা যায় না। তবে কিভাবে এই কাগজের ব্যাগটিকে ব্যবহার করা হবে তার উপর নির্ভর করে, তাও প্লাস্টিক ব্যাগের মতো অনেকবার ব্যবহার করা সম্ভব নয় কাগজের ব্যাগকে।
অপরদিকে কাপড়ের ব্যাগ উৎপাদন সবচেয়ে বেশী কার্বন-নিবিড় হলেও টেকসই এর দিক থেকে এই ব্যাগ সবার উপরে।
নর্থহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অধ্যাপক মার্গারেট বেটসের মত অনুসারে, আমাদের ব্যবহার করা সকল ধরনের ব্যাগের প্রভাব পরিবেশের ওপর থেকে যদি হ্রাস করতে হয় তাহলে এর চাবিকাঠি হলো এইগুলি যেভাবেই তৈরি করা হোক না কেন, যেন সেগুলি যথাসম্ভব পুনরায় ব্যবহার করা যায়।
কাগজ হোক প্লাস্টিক হোক বা কাপড়ের ব্যাগ হোক যেকোনো একটি ব্যাগকে যদি অধিক ব্যবহার করা হয় তাহলে পরিবেশের উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। কারণ পরিবেশের ওপর এগুলির জন্য অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। সেই জন্য একটি ব্যাগ যেভাবেই তৈরি করা হোক না কেন, যেন সেগুলি সর্বোচ্চ ব্যবহার করা সম্ভব হয়। তাই একবার ব্যবহার করা যায় এমন ব্যাগগুলো ব্যবহার করার পরিবর্তে যে ব্যাগগুলো পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করা সম্ভব সেগুলি ব্যবহার করা উচিত।