গ্রাম বাংলার পূজা

মনসাকে দেবী দূর্গার আসনে বসিয়ে পুজো করা হয় ৩০০ বছর ধরে

আমরা কমবেশি সকলেই জানি দেবী দূর্গার বিভিন্ন অবতার রয়েছে। যেমন- দেবী কৌশিকী, দেবী কালরাত্রি, দেবী ব্রহ্মানী, ইত্যাদি আরও কতো রূপ। তবে আমাদের সাধারণ ‌জ্ঞান অনুযায়ী মা মনসা এবং দেবী দূর্গাকে ভিন্ন দেবী হিসেবে গন্য করা হয়। কিন্তু খুবই আশ্চর্যজনক ভাবে এই গ্রামে দূর্গা পুজোর সময় দেবী দূর্গাকে নয় বরং মা মনসাকে দেবী দূর্গার আসনে বসিয়ে পুজো করা হয়।

কি খুবই অবাক লাগছে তো?! তাহলে জেনে নেওয়া যাক সত্যি ঘটনাটি ঠিক কি? 

বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দূর্গাপুজোতে যখন গোটা পৃথিবী মেতে ওঠে, তখন অন্য চিত্র দেখা যায় দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট ব্লকের বোয়ালদাড় গ্রাম পঞ্চায়েতের ফুলঘরা গ্রামে। কারণ এই গ্রামের মানুষরা দূর্গাপুজোর সময় মনসা পুজোয় মেতে ওঠেন। এই গ্রামের মানুষরা দেবী দূর্গার আসনে মনসাকেই বসিয়ে দীর্ঘদিন পুজো করে আসছেন। দূর্গাপুজোর নিয়ম মেনেই এখানে মা মনসা পূজিতা হন। মূলত এখানে মনসা রূপেই দেবী দূর্গার আরাধনা করা হয়। পুজোর কয়েকটা দিন গ্রামে সকলে মিলে আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেন। মিলন কেন্দ্র হয়ে ওঠে ফুলঘরা গ্রাম।

জানা গিয়েছে, প্রায় তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে দূর্গার আসনে মা মনসার পুজো হয়ে আসছে ফুলঘরা গ্রামে। পুরোনো নিয়ম,রীতি-রেওয়াজ কিছুই বদলায়নি আজও। জনশ্রুতি রয়েছে, বহুকাল আগে ফুলঘরা গ্রামের বহু ব্যক্তি সর্পাঘাতে মারা গিয়েছিল। শুধুমাত্র মানুষ নয়, সর্পাঘাতে অনেক পশুও মারা গিয়েছিল। বহু কিছু করেও সর্পাঘাতে মৃত্যু প্রতিরোধ করতে পারছিলেন না গ্রামবাসীরা। সেই সময় গ্রামের এক ব্যক্তি গুদর মণ্ডল স্বপ্নাদেশ পান। গ্রামে মনসা পুজো করলেই কেউ আর সর্পাঘাতে মারা যাবে না।

এরপর আত্রেয়ী নদীতে একদিন স্নান করতে গেলে মা মনসার কাঠামো ভেসে যেতে দেখেন তিনি। গ্রামবাসীরা সেই কাঠামো তুলে নিয়ে এসে মন্দিরে স্থাপন করে মা মনসার পুজো শুরু করেন। প্রথমে শ্রাবণ মাসে এই পুজো শুরু হয়। গোটা এলাকায় কোনও দূর্গাপুজো না হওয়ায় সেই পুজোর সময়টা বদলে শারদোৎসবে মা মনসার পুজো শুরু হয়। সেই থেকে দূর্গার আসনে মা মনসার পুজো করে আসছেন ফুলঘরা বারোয়ারি মনসা পুজো কমিটি। পুজোর কয়েকটা দিন চন্ডী ও মনসামঙ্গল গান হয়। সকলের আত্মীয়রা গ্রামে আসেন। এখানে মা মনসার একপাশে থাকেন দেবী লক্ষ্মী। অপর পাশে থাকেন দেবী সরস্বতী। পুজোর চার দিন নিয়ম মেনে গ্রামের সকলে নিরামিষ খাওয়ার খান।

আজও এই পুজোকে ঘিরে মেতে ওঠেন গ্রামের আট থেকে আশি সকলেই। বহিরাগত শিল্পী ও স্থানীয় শিল্পীদের দ্বারা পুজো প্রাঙ্গণে নাটক থেকে শুরু করে যাত্রা গান অনুষ্ঠিত হয়। পুজোর কয়েকটা দিন মেলা বসে ফুলঘরা গ্রামে। এতদিন ছোট মণ্ডপেই পুজো হতো মা মনসার৷ তাই ছোটো মন্দিরটি ভেঙে বড়ো করা হয়েছে বর্তমানে। মন্দির তৈরির কাজ চলছে।

এবিষয়ে ভজন মণ্ডল জানান, তাঁদের পূর্বসুরি গুদর মণ্ডল এই পুজোর প্রতিষ্ঠাতা। তাঁদের জায়গাতেই পুজোটা হয়। তবে এখন বারোয়ারি হিসেবেই পুজোটা হয়। বংশ পরম্পরায় পুরোহিত ও মৃৎশিল্পীর কাজ করে আসছেন নির্দিষ্ট পরিবার। পুজোর বায়না দিতেও হয় না বা ডাকতে হয় না। সময়মতো চলে আসেন সকলেই। এখনও পুজোতে আগের কাঠামোর বাঁশ দিতে হয়। এবিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা বিভোর সরকার বলেন, ‘‘পুজোর কয়েকদিন আগে গ্রামে ফিরে আসে সব বাড়ির ছেলেমেয়েরা। দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন। মানদ করেন তারা। মানদ পূরণ হলে মাকে বিভিন্ন অলংকার দেন।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *