নারীর নীরব কষ্ট এন্ডোমেট্রিওসিস
প্রতিমাসে মাসিকের সময় বমি হচ্ছে? অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগছে? এই ধরনের উপসর্গকে কি আপনারা সাধারণ সমস্যা ভেবে এড়িয়ে চলছেন? তাহলে খুব ভুল করছেন। কারন এই ধরনের উপসর্গ থাকলে অনেক সময় দেখা দিতে পারে ‘এন্ডোমেট্রিওসিস’ নামক এই রোগটি। যা নারীদের জন্য অনেক বড় ধরনের সমস্যার কারন হয়ে উঠতে পারে। তাই এখনই সতর্ক হয়ে যান এবং লক্ষ্য রাখুন যে আপনার এই রোগটির কোনো লক্ষন নেই তো। তার জন্য জেনে নিন এন্ডোমেট্রিওসিস কী? কেন হয়? এবং কি কি এই রোগের উপসর্গ থাকে?
এন্ডোমেট্রিওসিস কী?
‘এন্ডোমেট্রিয়াম’ জরায়ুর সবচেয়ে ভেতরের স্তরকে বলা হয়। এই এন্ডোমেট্রিয়ামে বিশেষ কিছু কোষগুচ্ছ থাকে, সেগুলি যখন জরায়ুর বাইরে অবস্থান করে তখন সেই অবস্থাকে এন্ডোমেট্রিওসিস বলা হয়।
এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার নির্দিষ্ট কোন বয়স সীমা নেই নারীদের, এমনকি টিনেজাররাও বাদ যায় না। এই রোগটিতে প্রতি ১০০ জনে অন্তত ১০ জন নারী ভুগে থাকেন।
কোন কোন স্থানে হতে পারে এন্ডোমেট্রিওসিস?
- ডিম্বনালী,
- ইউটেরাস বা জরায়ুর আশেপাশের লিগামেন্টগুলোতে,
- শ্রোণী গহ্বরের লাইনিংয়ে,
- ডিম্বাশয়ে,
- জরায়ুর বহিঃপৃষ্ঠে, এবং
- জরায়ু এবং মলাশয় বা মূত্রথলির মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে।
লক্ষণসমূহ
- ‘পেলভিক পেইন’ অর্থাৎ শ্রোণীদেশে ব্যথা হওয়া। এই ব্যথা মাসিক চলাকালীন সময়ে আরো তীব্র আকার ধারণ করে৷
- পিরিয়ডের সময় তীব্র ব্যথা হওয়া যা বাধাগ্রস্থ করতে পারে আক্রান্ত ব্যাক্তির দৈনন্দিন কাজকর্মকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ডিসম্যেনুরিয়া।
- মাসিক চলাকালীন সময়ে পায়খানা বা প্রস্রাব করার সময় ব্যথা অনুভব করা।
- তীব্র রক্তপাত হওয়া পিরিয়ডের সময়।
- যৌন সহবাস করার সময় বা পরে ব্যথা অনুভব করা।
- গর্ভধারণে সমস্যা হওয়া।
- এছাড়াও অসুস্থ অনুভব করা, বিষন্নতা, কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা, ডায়রিয়া এবং প্রস্রাব-পায়খানা করার সময় রক্তপাত হওয়া ইত্যাদি সমস্যা।
এন্ডোমেট্রিওসিসের কারণ
১. শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত বা লসিকার মাধ্যমে এন্ডোমেট্রিয়াল কোষগুচ্ছ পরিচালিত হলে।
২. যদি পরিবারে কারোর এই সমস্যা থাকে অর্থাৎ জিনগত কারণে হতে পারে।
৩. হিস্টেরেক্টমি বা সি সেকশনের মতো অপারেশনের হলে এন্ডোমেট্রিয়াল কোষগুলো অন্ত্র বা অন্য কোনো অঙ্গের প্রাচীরে লেগে যেতে পারে। যার ফলে সৃষ্টি হতে পারে রোগটি।
৪. আবার যদি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায় তখনও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারন শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার ফলে শরীর জরায়ুর বাইরে সৃষ্টি হওয়া এন্ডোমেট্রিয়াল কোষগুলোকে ধ্বংস করে দিতে পারে না।
রিস্ক ফ্যাক্টরস
- সঠিক বয়সের পূর্বে মাসিক শুরু হয়ে যাওয়া যেমন ১১ বছর বয়সের আগে।
- মেনোপজ বা রজঃনিবৃতি দেরিতে হওয়া।
- রজঃচক্র সংক্ষিপ্ত হওয়া অর্থাৎ ২৭ দিনের কম।
- আবারা ৭ বা তার অধিক দিন ধরে রজঃস্রাব হওয়া।
- শরীরের ওজনের সাথে উচ্চতার অনুপাত কম হওয়া যাকে সংক্ষেপে বলা হয় BMI।
- পারিবারিক ইতিহাসে যদি কারোর এই সমস্যা থাকে। যেমন মা, দিদি, বোন এন্ডোমেট্রিওসিস থাকে।
- অস্বাভাবিক জরায়ুর আকার।
- গর্ভাশয় যদি কোনো রোগ থাকে।
- শরীরে যদি এস্ট্রোজেন নামক হরমোন বেশি পরিমাণে উৎপন্ন হতে থাকে।
রোগপরবর্তী জটিলতা
- গর্ভধারণে অক্ষমতা বা জটিলতা সৃষ্টি হওয়া। এই রোগে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে প্রায় ৩৩%-৫০% নারী এই জটিলতায় ভুগে থাকেন।
- ওভারিয়ান ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। আবার যাদের একসময় এন্ডোমেট্রিওসিস ছিল তাদের এন্ডোমেট্রিওসিস অ্যাসোসিয়েটেড এডেনোকারসিনোমা। মানের এই ক্যান্সারও হতে পারে।
রোগনির্ণয় পদ্ধতি
- ল্যাপরোস্কপি,
- বায়োপসি,
- আল্ট্রাসাউন্ড, এবং
- এমআরআই (MRI)।
কিভাবে প্রতিরোধ করা যাবে?
এই রোগের সাথে মোকাবিলা করার নির্দিষ্ট কোনো পন্থা নেই। কারন এই রোগটি কি কারনে ঘটিত হয় তা অজানা অর্থাৎ এটি একটি ইডিওপ্যাথিক। সেই জন্য যখনই লক্ষণ দেখা দেবে সাথে সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করবেন। এর ফলে দ্রুত রোগনির্ণয় এবং চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হবে।
গর্ভধারণ এবং স্তন্যদান এন্ডোমেট্রিওসিসের হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করতে সাহায্য করে। এছাড়াও, প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় ফল রাখা, বিশেষ করে সাইট্রাসযুক্ত ফলসমূহ, বিশেষ উপকারী ভূমিকা পালন করে।
এই বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল টিভি সিরিজও। আর এটি হল-
স্যালি রুনির উপন্যাসের ভিত্তিতে নির্মিত ’করভারসেশন উইথ ফ্রেন্ডন্স’- এই টিভি সিরিজে তুলে ধরা হয়েছে এই রোগের উপসর্গগুলি। যেখানে দেখানো হয়েছে যে ‘ফ্রান্সিস’ নামের এই টিভি সিরিজের চরিত্রটি এন্ডোমেট্রিওসিসের যন্ত্রণায় কখনো ওয়াশরুমে কাতরাচ্ছে, আবার কখনো ভীড়ের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে যায়। এই টিভি সিরিজটি নির্মাণ করার জন্য সাহায্য নেওয়া হয়েছে নারী রোগবিশেষজ্ঞ তথা এন্ডোমেট্রিওসিস রোগের চিকিৎসায় অভিজ্ঞ চিকিৎসক ফিওনা রেইডির। এই সিরিজের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে এক এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত নারীর সংগ্রামকে।