মশার অস্তিত্ব পুরোপুরি বিলীন করে দেওয়া কি আদৌ সম্ভব?- প্রথম খণ্ড
মশা একটি ক্ষুদ্র প্রাণী হলেও তাদের কাজকর্ম মোটেও ক্ষুদ্র নয়। এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি এতটায় ভয়ানক যে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এই জন্য অনেক সময় মনে হয় যে যদি পৃথিবী থেকে মশা পুরোপুরিভাবে বিলীন হয়ে যেত তাহলে মশাবাহিত রোগের হাত থেকে মানুষ নিস্তার পেত। কিন্তু প্রশ্ন হল যে মশার অস্তিত্ব পুরোপুরি বিলীন করে দেওয়া কি আদৌ সম্ভব?
প্রকৃত অর্থে বলতে গেলে মশা এই ছোট প্রাণীটি আমাদের কোনো রকম কোনো উপকারে আসা তো দূরে থাক উল্টে আমাদের ক্ষতি করে। প্রতিবছর নানা মশাবাহিত রোগের কারণে প্রাণ হারাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। মশা বাহিত রোগের তালিকায় ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ছাড়াও থাকে চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাসের মতো নতুন নতুন মহামারী রোগ। প্রতি বছর অসংখ্য সুস্থ মানুষ একটি সামান্য মশার কামড়ের কারণে নিজেদের প্রাণ হারাচ্ছে। পরিস্থিতিটা এমন পর্যায় আসে পৌঁছেছে যে মানুষের কারণে মশার মৃত্যুর সংখ্যার থেকেও মশার কারণে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। গেটস ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্য অনুসারে, মশাবাহিত রোগের কারণে প্রতিবছর প্রায় ৭,২৫,০০০ জন মানুষের মৃত্যু হয়। যার মধ্যে কেবল ম্যালেরিয়ার কারণেই প্রায় ৬,০০,০০০ জন মানুষ মারা যায়। আর বড় সংখ্যার সাথে আরো ভয়াবহতা যোগ করেছে জিকা ভাইরাসের আগমন। এই ভাইরাস গর্ভবতী নারীদের জন্য খুব ক্ষতিকারক কারণ এই ভাইরাসের জন্য নবজাতক বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নেয়। আর এই বিশাল সংখ্যক মৃত্যুর জন্য কেবল মশার কামড় দায়ী।
কিন্তু প্রশ্ন হল যে মশার কামড়ের পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী। মশার খাদ্যের চাহিদা রক্ত মেটায় না। অন্য প্রাণীর রক্ত শুষে নেওয়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে বংশবিস্তার করা। একটি মশাকে ডিম উৎপন্ন করার জন্য প্রয়োজন হয় পুষ্টির। আর সেই পুষ্টি তারা সংগ্রহ করে রক্ত থেকে। ঠিক সেই জন্য পুরুষ মশারা নয় প্রাণীদের কামড় দেয় কেবল স্ত্রী মশাগুলো। তবে সকল প্রজাতির মশাই যে মানুষের রক্ত শোষন করে তা কিন্তু নয়। গোটা বিশ্বে মোট ৩,৫০০ প্রজাতির মশা রয়েছে। তাদের মধ্যে কেবল ২০০ প্রজাতির মশাই মানুষকে কামড় দিয়ে থাকে। আর এদের তালিকায় রয়েছে ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু বহনকারী অ্যানোফেলিস গণের মশা, ডেঙ্গু ও জিকা ভাইরাসের জন্য দায়ী এডিস এজেপ্টাই এবং চিকুনগুনিয়ার জন্য দায়ী এডিস অ্যালবোপিক্টাস ও এডিস এজেপ্টাই দুটোই।
মশা আমাদের কোনো উপকারেই আসা তো দূরের কথা উল্টে অকাল মৃত্যু বয়ে নিয়ে আসে যার কারণে বহু প্রাণ হারিয়ে যায়। আবার প্রশ্ন হল যে তাহলে আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থে ঠিক কতটা যুক্তিযুক্ত এদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে? লিভারপুল স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের জীববিজ্ঞানী প্রফেসর হিলারি র্যানসন বলেছে যে, “আমার মনে হয় না আমজনতার মশাকে পুরোপুরি বিলীন করে দেওয়ার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ রয়েছে। আমি বেশিরভাগ সময় এদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি কেবল গবেষণা করার জন্য। কিন্তু তা কেবলই এদের মেরে ফেলার উপায় বের করার জন্য।”
কথায় বলা সহজ হলেও কাজে করা ততটাও সহজ নয় পৃথিবী থেকে মশার অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার। ৩,৫০০ প্রজাতির মশার মধ্যে কেবল ২০০ প্রজাতিই মানুষকে বিরক্ত করে থাকে। আর এর পেছনে মানবিক ব্যাখা থাকার পাশাপাশি রয়েছে দার্শনিক ব্যাখাও। শুধুমাত্র মানুষের সুবিধার্থের জন্য ১০০ মিলিয়ন বছরেরও পুরনো এক প্রাণীকে প্রকৃতি থেকে একেবারে বিলীন করে দেওয়াটা কি সত্যিই ঠিক কাজ? প্রকৃতির উপর আমাদের এই সেচ্ছাচারী মনোভাব প্রদর্শন আপাতদৃষ্টিতে প্রকৃতির কাছে আমাদেরকে শত্রু বানিয়ে দেয়। এছাড়াও এই কাজের জন্যও প্রকৃতিকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হতে পারে।
এটা যেমন ঠিক যে মশা আমাদের কাছে একটি অত্যন্ত বিরক্তিকর প্রাণী আবার অন্যদিকে এই প্রাণীটি অন্যান্য নানা প্রাণীর কাছে খাদ্যের উৎস। মশার লার্ভা খেয়ে বিভিন্ন মাছ বেঁচে থাকে। এছাড়াও মশা ছোট ছোট পাখি, ব্যাং ও কিছু বড় বড় পতঙ্গের খাদ্য। তাই যদি এরা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে তা প্রাকৃতিক খাদ্য শৃঙ্খলের উপর প্রভাব ফেলবে। এছাড়াও আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে ফুলের পরাগায়ণেও মশা অংশগ্রহণ করে। ফুলের নেকটার খেয়ে কিছু কিছু মশা জীবনধারণ করে। এমন কি গাছের জন্য কিছু ক্ষতিকর প্রোটোজোয়া মশার খাদ্য। তাই যেমন মশা না থাকলে উদ্ভিদের পরাগায়ণ ব্যাহত হবে, ঠিক তেমনি কিছু গাছের যথাযথ বৃদ্ধি হবে না। তাই আমাদের জন্য অপ্রয়োজনীয় হলেও প্রকৃতির জন্য মশার প্রয়োজন রয়েছে।