ফিচার আর্টিকেল

নারীদের অনিয়মিত পিরিয়ডের সমস্যায় বর্তমানে ইরানে ব্যবহার করা হয় এই বিশেষ ফলটি। আসুন জেনে নেওয়া যাক মধ্যযুগের এই ফলটির ব্যাপারে

কালের চক্রে এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছে বহু সম্পদ। তবে তাদের মধ্যে আবার কিছু সম্পদের অস্তিত্ব বর্তমান দিনেও টিকে রয়েছে, যেমন প্রত্নতত্ত্ববিদরা ২০১১ সালে রোমান সাম্রাজ্যের একটি শৌচাগারে অপ্রত্যাশিত কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন। এছাড়াও প্রাচীন কালে টাসজেটিয়াম নামের একটি গ্রাম ছিল যা বর্তমানে সুইজারল্যান্ডে অবস্থান করে। এই গ্রামটি ছিল তৎকালীন সেল্টিক সাম্রাজ্যের অধীনে শাসনকৃত যা মূলত জুলিয়াস সিজারের পক্ষ থেকে একটি উপহার ছিল। তৎকালীন সময়ে রাইন নদীর তীরবর্তী অঞ্চলসমূহ ছিল বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলে বাসিন্দাদের কাছে এই জলপথটি ছিল অত্যন্ত অপরিহার্য কারন এই জলপথটি দ্বারা পণ্য পরিবহন এবং যাতায়াতের সুবিধা ছিল। আর এই নদীর অববাহিকায় অবস্থিত ছিল টাসজেটিয়াম নামের এই গ্রামটি।

এই রাইন নদীর তলদেশে হারিয়ে গিয়েছিল রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের বেশ কিছু সম্পদ। সময়ের কালচক্রে প্রাচীনকালের যেসব অমূল্য প্রমাণ হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল কর্দমাক্ত পরিবেশে অক্সিজেন গ্যাসের অভাবে কারনে তাদের মধ্যে অধিকাংশই টিকে রয়েছে।

প্রত্নতত্ত্ববিদরা সেখান থেকে প্লাম, চেরি, পীচের মতো অতি সাধারণ ফলের সন্ধান পাওয়া ছাড়াও খুঁজে পেয়েছিল  ১৯টি বড় আকারের অদ্ভুত ফলের বীজ যা তাদেরকে অবাক করে দিয়েছিল। আনুমানিকভাবে যদি ধরে নেওয়া হয় যে ২০০০ বছর আগেকার ঘটনা তাহলে এই  ১৯ খানা বীজের যেরকম অবস্থা ছিল তা দেখে মনে হয়েছে যে সেগুলো যেন গতকালই  কেউ ওখানে রেখে গিয়েছে। বলতে গেলে বলা যায় যে এই ১৯টি বিশালাকার ফলের বীজ উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদেরকে হতচকিত করে দিয়েছে।   

নাম যখন অন্যরকম

বর্তমান দিনে এই ফলটি মেডলার নামে পরিচিত। কিন্তু এই ফল যখন খুব জনপ্রিয় পরিচিতি ছিল সেই সময় এই ফলটির নাম ছিল ‘ওপেন-আর্স’। এই রকম নাম হওয়ার পিছনে কারন ছিল যে এই ফলটির তলার অংশের সাথে মানুষের অঙ্গের মিল ছিল। এই বিষয়ে ফরাসিদের মতো রসিক বোধ হয় খুব কমই আছে। তারা এই ফলটিকে বিভিন্ন নাম ডাকত যেমন চতুষ্পদী তলা, গাধার তলা, বানরের তলা, কিংবা কুকুরের তলা ইত্যাদি। ফলটির যেরকম অদ্ভুত নাম ঠিক সেরকমই দেখতেও অদ্ভুত। তবে  এই অস্বস্তি উদ্রেককারী ফলটির জন্য মধ্যযুগের ইউরোপের মানুষরা বলতে গেলে এককথায় পাগল ছিল।

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া

মেডলার নামের এই ফলটি অস্তিত্ব সম্পর্কে এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ হল খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর গ্রিক কাব্য। মনে করা হয় যে এই ফলটি কিছু ভাবে রোমানদের হাতে এসে পৌঁছে ছিল। আর সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল এই ফলের যাত্রা। এই ফল ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে  ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চল এবং ব্রিটেনেও যা ঘটেছিল রোমানদের দৌলতেই।  

মেডলারের নাম প্রথমবারের মতো চার্লস দ্য গ্রেট রাজার সকল বাগানে বাধ্যতামূলকভাবে থাকা উদ্ভিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল মধ্যযুগের শুরুর দিকে। এরপর ২০০ বছর পর মেডলারের নাম প্রকাশ্যে ব্যবহারের জন্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন ইংলিশ লেখক তথা অ্যাবট (সন্ন্যাসীদের প্রধান) এলফ্রিক অভ আইনশ্যাম। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে সেই সময়কালে কেউ এই ফলটিকে মেডলার নামে ডাকত না অর্থাৎ সেই সময়ে তিনি মেডলারের ছদ্মনাম নাজুক ব্যবহার করেন।

এর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে মধ্যযুগীয় চিত্রকলা সমৃদ্ধ ধর্মগ্রন্থ অ্যানি অভ ব্রিট্যানিস বুক অভ আওয়ারস থেকে শুরু করে শেক্সপিয়ারের রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটসহ একাধিক সাহিত্যে।

১৬০০ সালের দিকে এই ফলটির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠেছিল। ব্রিটেনে যখন মালবেরি, কুইন্স, পিয়ারস, আপেল ইত্যাদি আর দশটা ফলের মতো এই ফলের চাষও শুরু হলো সেই সময় থেকে বিস্তৃত আকারে  শুরু হয়  মানুষের উন্মাদনা এই ফলটিকে নিয়ে। এক সময়ে তুমুল জনপ্রিয়তার শিখরে থাকা ফল মেডলারের ধ্বস নামতে শুরু করে ১৯৫০ সালের দিক থেকে এরপর ২০০০ সাল নাগাদ  ধীরে ধীরে বিস্মৃত হয়ে যেতে শুরু করে এই ফলটি। 

একসময়ে মানুষের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান রাজ করা এই ফলটি বর্তমান সময়ে তা নিতান্তই শখের জন্য চাষ করা হয়ে থাকে। এই ফলটিকে বিভিন্ন কৌতূহলী ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ অতীতের প্রতি একধরনের রোম্যান্টিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে চাষ করে থাকেন। একে বিশেষত দেখা যায় জাদুঘরে বা প্রাচীন কোনো প্রাসাদে। 

এ ফল খাওয়ার প্রক্রিয়া 

মেডলার ফলটির দুটি বিশেষত্ব হল – প্রথমত এই ফলটি শুধুমাত্র শীতকালেই চাষ করা হয়। শীত ঋতুতে  মধ্যযুগে শর্করার উৎস হিসাবে এই ফলটি ছিল অন্যতম। এই ফলটি পাকার সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া যেত না কারণ ওই অবস্থায় যদি কেউ খায় তাহলে সেই ব্যাক্তি তৎক্ষণাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ত। এটি সম্পূর্ণভাবে পচে যাওয়ার পরেই খাওয়ার জন্য উপযুক্ত হতো। ফলটি না পচিয়ে খেলে দেখা দিত খুব ভয়াবহ রকমের ডায়রিয়ার প্রকোপ। 

অপর দিকে এই ফলটিকে খোলা পরিবেশে কয়েক সপ্তাহ রেখে দিলে দেখা যেত যে কালচে রং এর হয়ে গেছে এবং দেখতে বেক করা আপেলের মতো হয়ে যেত। আর এইরকম অবস্থায় এটি খেলে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকত না। এই প্রক্রিয়াটিকে ব্লেটিং বলা হয়, আর এটি হল এর বিশেষত্বের অন্যতম একটি কারণ।

ব্লেটিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মেডলারে মধ্যে থাকা জটিল শর্করাগুলো বিশ্লিষ্ট হয়ে পরিণত হত গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজের মতো ক্ষুদ্র সরল শর্করায়। মেডলারে যত বেশি পচন ধরে ঠিক তত বেশি  বৃদ্ধি পায় ম্যালিক অ্যাসিডের পরিমাণ। উচ্চ মাত্রায় ম্যালিক অ্যাসিড থাকার জন্য আপেলের মতো এতে কিছুটা টক স্বাদ চলে আসে। অপর দিকে হ্রাস পায় ট্যানিন আর অ্যান্টি অক্সিড্যান্টের মাত্রা।  সব মিলিয়ে এই ফলটিতে অত্যধিক মিষ্টত্বের পাশাপাশি একটা সূক্ষ্ম টক স্বাদ থাকে। এই ফলটিকে অত্যধিক মাত্রায় পেকে যাওয়া খেজুরের সাথে তুলনা করা যেতে পারে এবং তার স্বাদটা  পেকে যাওয়া খেজুরের সাথে কিছুটা লেবুর রস মিশিয়ে খেলে যেমন লাগবে ঠিক অনেকটা তেমন। 

হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য কারণ

ঠিক কি কারনে প্রায় নিশ্চিহ্ন পথে চলে গিয়েছিল মেডলা ফলটি তা নিয়ে রয়েছে নানা মতভেদ। কেন টিকে থাকতে পারে নি এই ফলটি? সেই প্রশ্নের উত্তরে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যাটি ছিল যে এই ফলটি  অন্য ফলের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে পারেনি।  প্রায় সারা বছরই চাষ করা যায় এমন ফলের যেমন- কলা, আনারস ইত্যাদি সাথে পাল্লা দেয় মেডলার, সেক্ষেত্রে  মেডলারের পক্ষে মানুষের মনে চিরস্থায়ী আসন করে নেওয়াটা সত্যিই দুষ্কর ছিল। কারন সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ বুঝতে শিখেছে যে এমন কিছু ফল আছে যেগুলি বারোমাসি ফল। এমনকি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হওয়ার কারনে দাম কমে যায়, অন্যদিকে এক শীতকালীন আভিজাত্য হিসেবে রয়ে গেছে মেডলার। তাই এই ফলের হারিয়ে যাওয়াটা অনেকটা সুনিশ্চিত ছিল।

অন্য আরেকটি ব্যখ্যা অনুসারে,  ততদিনে মানুষের কাছে চলে এসেছিল মেডলারের বিকল্প। মেডলার খাওয়ার জন্য তীব্র শীতে ঘর থেকে বের হয়ে এই ফলটি চাষ করার ক্ষেত্রে কেউ খুব একটা ইচ্ছুক ছিল না।  স্বাভাবিকভাবেই  গ্রীষ্মকালে মানুষ বেশি কর্মক্ষম থাকার পাশাপাশি  প্রাণচাঞ্চল্য থাকে। সেই দিক থেকে যদি বিচার করা হয় তাহলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে মেডলারের আবাদ মোটেই জুতসই অভীপ্সা ছিল না।

শেষ কথা

বর্তমান দিনে ইরান, আজারবাইজান, কিরগিজস্তান, জর্জিয়া, এবং তুরস্কতে মেডলার  চাষ করা হয়ে থাকে। পেটের সমস্যা এবং নারীদের অনিয়মিত মাসিক ইত্যাদি সমস্যার সমাধানে ইরানের বেশ কিছু কিছু স্থানে মেডলার গাছের পাতা, বাকল, কাঠ, এবং ফল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মধ্যযুগের ইউরোপেও যে এই ফলটি এই রকম কাজে ব্যবহার করা হয়েছে তার প্রমান রয়েছে গবেষণায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *