বেশিরভাগ বিজ্ঞানী স্বপ্ন দেখেন নোবেল পুরস্কারের। কিন্তু এই নোবেল পুরষ্কারের পিছনের ইতিহাস কি?
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার বলা হয় ‘নোবেল’কে। এই নোবেল পুরস্কার জিতেই বাঙালি জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে অমর্ত্য সেন,মাদার টেরেসা এবং সদ্য পাওয়া অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এই নোবেল পুরস্কার এর পিছনে রয়েছে এক বিরাট ইতিহাস, আজকে কথা বলবো এই ইতিহাস নিয়ে।
সময়টা ১৮০০ সাল। সকালে ঘুম থেকে নিউজ পেপার খুলে চমকে গেলেন আলফ্রেড। দেখলেন তার মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়েছে, আর লেখা হয়েছে ”মৃত্যু নিয়ে ব্যবসা করা ব্যবসায়ীর মৃত্যু”। পত্রিকা যে তার ভাইয়ের মৃত্যুর সাথে তাকে গুলিয়ে ফেলেছে সেটা বুঝলেন আর এটাও বুঝলেন যে তার মৃত্যুর পর তাকে পৃথিবী কি ভাবে মনে রাখবে।
তাই ব্যবসায়ীক আলফ্রেড পাল্টে গেলেন মানব দরদি আলফ্রেডে। শুরু করলেন নানা ধরণের জিনিস নিয়ে গবেষণা যাতে উপকার হবে এই মানব জাতির। সারা জীবনে আবিষ্কার করেছেন তিনশো-এর বেশি পেটেন্ট, এর পাশাপাশি লিখেছেন অনেক বই আর উপন্যাস, কবিতা, নাটক। এই জন্য ভিক্টর Hugo তাকে বলেছিলেন “মধ্য প্রাচ্যের সব চেয়ে ধনী ভ্যাগাবন্ড। ”
আলফ্রেড নোবেলের জন্ম হয় সুইডেন স্টকহোমে। ১৮৩৩ সালের ২১ এ অক্টোবর। সেন্ট পিটসবার্গে নিজের স্কুল জীবন শেষ করে পারি দেন আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানিতে উচ্চ শিক্ষার জন্য। প্যারিসে তার সাথে আলাপ হলো বিজ্ঞানী সোবেরার সঙ্গে। যিনি নাইট্রোগ্লিসারিন আবিষ্কার করেছিলেন। আলফ্রেড তার কাছ থেকে নাইট্রোগ্লিসারিন বিজ্ঞানটা রপ্ত করে ফেললেন।
তারপর রাশিয়াতে ১৮৫২ সালে ফিরে নিজের পরিবারের অস্ত্র ব্যবসাতে যোগ দিলেন। এর পাশাপাশি নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে থাকলেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে চালাতে নাইট্রোগ্লিসারিন এর সাথে বারুদ মিশিয়ে বানিয়ে ফেললেন ব্লাসটিং ওয়েল । আর বিস্ফোরণের জন্য ফিউজ যুক্ত ব্লাসটিং ক্যাপ।
দুটোর পেটেন্ট তৈরী থাকলেও তার ভাগ্য তার সহায় হলো না, যুদ্ধ শেষে সব ব্যাংক ফেল করলো আবার সব হারিয়ে ফিরে এলেন জন্মস্থানে। অবশেষে নিজের ভাইকে সাথে নিয়ে শুরু হল পরীক্ষা, কিন্তু এবার আরও বড়ো বিপদ ঘটলো । পরীক্ষা চলাকালীন বিস্ফোরণ এ মারা গেলো ভাই এমিল। এর কিছুদিন পর তার বাবা ইমায়ুয়েলও পুত্র হারানোর শোকে মারা গেলেন। অবশেষে পুরো ব্যবসা গেল আলফ্রেডের ঘাড়ে।
চারিদিকে ব্লাসটিং ওয়েল এর চাহিদা বাড়ছে, সেটা বুঝতে পেরে জার্মানী আর স্কটল্যান্ডে কারখানা খুললেন তিনি। কিন্তু এই ব্লাসটিং ওয়েল থেকে বিস্ফোরণের ফলে শ্রমিকদের মৃত্যুও বাড়ছে, তাই উপায় খুঁজতে লাগলেন। পেয়ে গেলেন কিছু দিনের মধ্যে। জার্মানির ক্রমেলে গিয়ে এক অদ্ভূত ধরণের বালি দেখতে পেলেন অ্যালফ্রেড। পরীক্ষা করে দেখলেন এই বালি দিয়ে পুর বানিয়ে তার মধ্যে নাইট্রোগ্লিসারিন ভোরে দিলে আর বিস্ফোরণের ভয় থাকছে না, তখন শুধুমাত্র তার আবিষ্কার করা ব্লাসটিং ক্যাপ দিয়ে বিস্ফোরণ হচ্ছে। ১৮৬৭ সালে এই নতুন বিস্ফোরক এর পেটেন্ট নিলেন, নাম দিলেন ‘ডাইনামাইট’। গ্রিক শব্দ “dunamic” এর অর্থ প্রবল বিস্ফোরণ, সেখান থেকে নাম রাখলেন তিনি।
তার ব্যবসা আরও বড়ো হল, কুড়িটি দেশে ৯০ টির বেশি কারখানার মালিক হলেন। একের পর এক গবেষণাগার স্থাপন করলেন। ১৮৮৭ সালে আবিষ্কার করলেন ধোয়াহীন ব্যালিস্টাইট। তিনি প্রথমে ফ্রান্সকে ব্যালেসাইট বিক্রি করতে চাইলেও ফরাসি সরকার বিশেষ গা করেনি, তা তিনি ইটালি কে বিক্রি করে দিলেন। এতে ফরাসি সরকার তার বিরুদ্ধে দেশ দ্রোহীতার অভিযোগ আনে এবং তার গবেষণাগার ও কারখানা কেড়ে নেয়। তাই ভয়ে ইতালির সানরেমোতে গিয়ে থাকতে শুরু করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ভীষণ লাজুক আর চুপচাপ আর একলা ছিলেন তিনি। ভীষণ হার্ট আর মাথার সমস্যায় ভুগতেন। ক্রমশ হার্টের অবস্থা খারাপ হতে থাকে, যে nitroglycerin তিনি আবিষ্কার করেছিলেন হার্টের অসুখ সারানোর জন্য তাকে সেই ওষুধ খেতে হয়ে ছিল। অবশেষে ওই সানরেমোতে ১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি মারা যান।
মারা যাওয়ার আগে তিনি একটি উইল করে যান যার জন্য তিনি জগৎ বিখ্যাত। সেই উইল এ একটা ফাউন্ডেশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যার নাম ‘নোবেল ফাউন্ডেশন’ যাদের কাজ হবে প্রতি বছর পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, সাহিত্য আর শান্তির জন্য পৃথিবীর সেরা মানুষটাকে পুরষ্কৃত করা। এবার সমস্যা শুরু হলো কোন দেশ এই পুরস্কার দেবে তা নিয়ে।
সুইডেন বললো আলফ্রেড তাদের দেশের নাগরিক না সুতরাং এই দায়িত্ব তারা নেবেন না, একই সুরে সুর চড়ালো ফ্রান্স, জার্মান, রাশিয়া আর ইতালি। আলফ্রেড কোন দেশের নাগরিক তা নিয়ে সবাই ধন্ধে, কারণ আলফ্রেড বলেছিলেন তিনি ঘরে বসে কাজ পছন্দ করেন, আর গোটা পৃথিবীটাই তার ঘর। অবশেষে ফরাসি দেশের নিয়ম অনুযায়ী যে মানুষ তার ঘোড়ার গাড়ি সে দেশে রাখে সেটাই তার দেশ।
মারা যাওয়ার আগে আলফ্রেড তার ঘোড়ার গাড়িটা সুইডেনে নিয়ে গেছিলেন, তাই তিনি সুইডেনের নাগরিক হলেন। তার গোটা সম্পত্তি বিক্রি করে মাত্র ত্রিশ মিলিয়ন ক্রোনার যার এখন মূল্য মাত্র তিনশো মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু এতে পুরষ্কার চালু করা গেলো না। সমস্যা শুরু হল নোবেল শান্তি পুরষ্কার নিয়ে, এই পুরষ্কার আলফ্রেড দিয়েছিলেন নরওয়ে নোবেল কমিটিকে। সুইডেন প্রথমে তাদের ঘাড় থেকে এই দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চাইলো, কিন্তু আলফ্রেডের উইল অমান্য করা মুশকিল, শেষে সুইডেনের রাজা দেখলেন যে অনেক দিন ধরে সুইডেনের স্বাধীনতার জন্য বলে আসছিলেন, তাই এমন একটা পুরষ্কারের দায়িত্ব দিলেন সেটা না মানলে পুরষ্কার বৃথা হয়ে যাবে। অবশেষে ১৯০০ সালে ২৯ জুন রাজা দ্বিতীয় অস্কার নোবেল ফাাউন্ডেশনকে মান্যতা দিল। ১৯০১ সালে প্রথম বারের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়। তবে ১৯৬৯ থেকে অর্থনীতির জন্য নোবেল পুরষ্কার দেয় সেন্ট্রাল ব্যাংক অফ সুইডেন। নোবেলের সমমানের পুরষ্কার এটি।
আলফ্রেড মজা করে বলতেন “আমার মাথায় অনেক আইডিয়া কাজ করছে তার একটা কাজ করলেই আমি খুশি।” মৃত্যু ব্যবসায়ী থেকে নিজেকে বিশ্বের পরম কল্যাণময় চরিত্র করে তুললেন তিনি। শুধু একটা আইডিয়ার জোরে।