কেন নেতাজি উপাধি পেয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু
নিউজ ডেস্ক -২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে আজ ৭৬ তম স্বাধীনতার স্বাদ নিচ্ছে গোটা দেশবাসী। কিন্তু এই স্বাধীনতা না এসেছে একদিনে আর নাই এসেছে একজনের জন্য। দীর্ঘদিন ব্রিটিশ তথা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে লক্ষাধিক বীর সংগ্রামীরা নিজেদের জীবনের বলিদান দিয়েছিলেন বলেই আজ এসেছে এই স্বাধীনতা। তবে সোজা ছিল না, পরাধীন দেশ কে স্বাধীন করার সেই সংগ্রাম। দীর্ঘদিন যাবত আনুমানিক ১০০ বছর ব্রিটিশরা ভারত শাসন করার পর দেশকে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন করার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু সহ বর্তমানে অজানা অনেক বীর বিপ্লবী। তবে সমস্ত সংগ্রাম কিংবা যেকোনো কর্মসূচির একজন এমন ব্যক্তি তাকে যাকে সকলের লিডার বলে মনে করেন আর তিনিই ছিলেন নেতাজি। যদিও সুভাষচন্দ্র বসু এই নেতাজি উপাধিটা সহজে পাননি। প্রাই ব্রিটিশ সরকারের নেতৃত্বাধীন ১১ বার হযরত বাস করে ও অসহনীয় অত্যাচার সহ্য করার পর বিপ্লবী ভালোবেসে সুভাষচন্দ্র বসুকে নেতাজি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। বিস্তারিত ভাবে বলা যাক এই উপাধি পাওয়ার পেছনের সম্পূর্ণ গল্পটা।
সময়টা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর আগের ঘটনা। তখন প্রথম বাংলায় রাজনৈতিক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল কংগ্রেস। আর সেই কংগ্রেস পার্টিতেই পরপর দু’বছর সভাপতি হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। কিন্তু বেশিদিন এই সভাপতিত্ব করতে পারেননি তিনি। কংগ্রেস পার্টির অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক মতপার্থক্য এবং মহাত্মা গান্ধীর সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত হতেন না সুভাষ। যার ফলস্বরূপ কয়েক দিনের মধ্যেই কংগ্রেস দল ত্যাগ করে নিজের দল ফরওয়ার্ড ব্লক তৈরি করেছিলেন তিনি। কারণ বোস মনে করতেন যে মহাত্মা গান্ধীর অহিংসবাদ নীতি দেশ স্বাধীনতার জন্য পর্যাপ্ত নয়। অন্যের অধীনে থেকে কাজ করার থেকে নিজে স্বাধীনভাবে দল তৈরি করে নিজের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করা ঠিক বলে মনে করেছিলেন সুভাষচন্দ্র।
ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগদান করেছিল ভারতের বহু বীর যুবক-যুবতীরা। এরপরই সকলের একত্রিত আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বহুবার দেশ স্বাধীনতার প্রস্তাব রেখেছিলেন বোস। কিন্তু সরকার সেই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় প্রায় ১১বার কারারুদ্ধ করেছিল সুভাষচন্দ্রকে। যদিও তার কাছে এই কারারুদ্ধ কোন মূল্যই রাখত না। যখন ব্রিটিশ সরকার দেখল সুভাষচন্দ্র বসুকে কারারুদ্ধ করেও কোন লাভ হচ্ছে না তিনি বারংবার স্বাধীনতা সংগ্রামে ময়দানে নামছেন তখনই ভারত থেকে সুভাষচন্দ্র বসুকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করার নোটিশ দিয়েছিলেন ইংরেজ সরকার।
অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরেও কোনরকম পরিবর্তন ঘটেনি সুভাষের। উপরন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ব্রিটিশদের দুর্বলতা ধরে নিয়ে ভারত ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি ও জাপান ভ্রমণ করেন ভারতে ব্রিটিশদের আক্রমণ করার জন্য সহযোগিতা খুঁজে বেরাছিলেন ভারত মাতার এই বীর সন্তান।
দীর্ঘদিনের খোঁজের পর অবশেষে জাপানিদের সহযোগিতায় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করেন এবং পরে তার নেতৃত্ব দান করেন। এই বাহিনীর সৈনিকেরা ছিলেন মূলত ভারতীয় যুদ্ধবন্দি এবং ব্রিটিশ মালয়, সিঙ্গাপুর সহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে কর্মরত মজুর। জাপানের আর্থিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় তিনি নির্বাসিত আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বদান করে ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে ইম্ফল ও ব্রহ্মদেশে যেটি বর্তমানে মায়ানমার নামে পরিচিত সেখানে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নাৎসি ও অন্যান্য যুদ্ধবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের জন্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ সুভাষচন্দ্রের সমালোচনা করেছেন। একদিকে যেমন কিছু মানুষ সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে সমালোচনা করেছেন সেখানে অন্য একাংশ মানুষ ইস্তাহারকে রিয়েলপোলিটিক – এর নির্দেশ বলে উল্লেখ করে রাজনৈতিক ও সামাজিক পথপ্রদর্শক মনে করেছেন।
অন্যদিকে আবার কংগ্রেস দল ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস বা ভারতের অধিরাজ্য মর্যাদার পক্ষে মত প্রকাশ করেছে সেখানে একেবারে অন্যদিকে দাঁড়িয়ে স্বাধীন ভারতের দাবি করেছিলেন একমাত্র নেতাজি। আর সুভাষচন্দ্র বসুর এই দাবিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন স্বয়ং জহরলাল নেহেরু সহ সিংহভাগ ভারতবাসী।
ভারত স্বাধীনতার দাবি রাখার পরপরই জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে কংগ্রস পূর্ণ স্বরাজ মতবাদ গ্রহণে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু সে সময় অন্যতম বীর স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি সহ তাঁর জীবন রক্ষায় কংগ্রেসের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ হয়ে সুভাষচন্দ্র গান্ধি-আরউইন চুক্তি বিরোধী একটি আন্দোলন শুরু করেছিলেন। পুনরায় আন্দোলনের আগুনে ঘৃতাহুতি করার জন্য কারারুদ্ধ করে ভারত থেকে নির্বাসিত করা হয়েছিল সুভাষচন্দ্রকে। কিন্তু কোন নিয়মই মানেননি তিনি। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে তিনি ভারতে ফিরে এলে আবার তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। মনে করা হয় ১৯৪৫ সালের ১৮ই অগস্ট তাইওয়ানে একটি বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। তবে আজও রহস্যে ঘেরা নেতাজির আসল মৃত্যুর ঘটনা।
তবে বারংবার ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা করে নেতাদের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার এই দৃশ্য দেখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার রচয়িতা একটি নৃত্যনাট্য সুভাষচন্দ্র বসুর নামে উৎসর্গ করে তাকে দেশনায়ক উপাধি দিয়েছিলেন। এছাড়াও নাৎসি জার্মানিদের তৈরি একটি ইউনিট যেটি দি ইন্ডিয়ান লিজিয়ন নামে পরিচিত, সেই ইউনিটের সদস্য ছিল অধিকাংশ ভারতীয়। এই ভারতবাসীরাই ১৯৪২ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তরধানে চলে যাওয়ার আগেই তাকে নেতাজি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই নেতাজি উপাধি প্রথমে রাজ্য, তার পরে দেশ এবং পরবর্তীতে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। আজও বাঙ্গালীদের তথা দেশপ্রেমিকদের কাছে নেতাজি উপাধিটাই যথেষ্ট সুভাষচন্দ্র বসুকে চেনার জন্য।
দেশ স্বাধীনতার জন্য নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর যে আজাদ হিন্দ ফৌজ তৈরি করেছিলেন সেটি খুব একটা সফলতা অর্জন করতে না পারলেও সকলের মনে গেঁথে গিয়েছেন বোস। সেই কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পরেও নেতাজির জন্মদিন উপলক্ষ্যে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরা, আসামে ও ওডিশায় রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। স্বাধীনতার পর কলকাতার একাধিক রাস্তা তাঁর নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। বর্তমানে কলকাতার একমাত্র ইন্ডোর স্টেডিয়াম নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম তাঁর নামে নামাঙ্কিত। নেতাজির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে দমদম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তিত করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা হয়েছে। তাঁর নামে কলকাতায় স্থাপিত হয়েছে নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও নেতাজি সুভাষ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং দিল্লিতে স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি। কলকাতা মেট্রোর দুটি স্টেশন বর্তমানে নেতাজির নামাঙ্কিত ‘নেতাজি ভবন’ (পূর্বনাম ভবানীপুর) ও ‘নেতাজি’ (পূর্বনাম কুঁদঘাট)।