ডিফেন্স

চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তাইওয়ানের নতুন সজারু নীতি। এটি কি ধরনের যুদ্ধনীতি জানেন?

রাজেশ রায়:— চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে ঝামেলা ক্রমশ যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব এর মধ্যেই সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রিতে দেখা যাচ্ছে। তাইওয়ানের আশেপাশে চীন একের পর এক মিলিটারি এক্সারসাইজ ও মিসাইল লঞ্চিং করে যাচ্ছে। চীন আমেরিকার সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে তা সে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেই হোক কীংবা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যেই হোক। যখন কোন দেশ এমন করে তখন সেই দেশটির অন্য দেশে আক্রমন করার সম্ভবনা অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। তবে চীন যে তাইওয়ান আক্রমন করবেই তা এখনই জোরালো ভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে তাইওয়ানের একটা অদ্ভুত স্ট্রাটেজি নিয়ে আলোচনা চলছে তা হচ্ছে পরকিউপাইন নীতি বা বাংলায় যাকে বলে সজারুর নীতি। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

আমেরিকা, আফ্রিকা, ভারতীয় উপমহাদেশে সজারু পাওয়া যায় খুবই তবে চীনে সজারু খুব কম পাওয়া যায়। জঙ্গলে সজারুকে শিকার করতে সবচেয়ে বেশী কষ্ট পেতে হয় বাঘ, সিংহ বা অন্যান্য মাংশাসী প্রানীকে। কারন প্রাকৃতিক ভাবেই সজারুর গায়ে প্রচুর কাঁটা থাকে। এগুলোই সজারুকে আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করে। এই কাঁটা গুলো অত্যন্ত শক্ত প্লাস্টিকের মতন। সজারু যখমই বিপদে পড়ে তার কাঁটা বেরিয়ে আসে। সেজন্য সহজে কোন প্রানী সজারু শিকার করে না যদিও কোন প্রানী প্রচন্ড ক্ষুধার্ত হয়ে বাধ্য হয়ে সজারু শিকার করে তাহলে তার গায়ে, মুখে প্রচুর কাঁটা ফুটে যায়। সেই প্রানীটি সজারুকে শিকার তো করে কিন্তু কীছুদিনের মধ্যেই এত কাঁটার জন্য যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যু বরন করে। তাইওয়ানও এই ধরনের স্ট্রাটেজি নিয়েছে।  প্রকৃতি থেকে অনুপ্রানিত হয়ে ২০০৮ সালে আমেরিকান নেভাল ওয়ার কলেজের প্রফেসর উইলিয়াম এস মারি এই পরকিউপাইন নীতি তৈরি করেন। যার  উদ্দেশ্য একটি ছোট দেশ যার প্রতিরক্ষা বাজেট কম, যুদ্ধাস্ত্র, ট্যাঙ্ক,সাবমেরিন কম সে কীভাবে বড় দেশের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করবে। তবে ২০১৭ সালে তাইওয়ানের মিলিটারি ফোর্সের প্রধান লি হাসি মিং এই নীতির একটি তাইওয়ানিজ ভার্সন তৈরি করেন যার নাম ওভারঅল ডিফেন্স কনসেপ্ট। কারন প্রতিটি দেশের ভৌগলিক অবস্থান আলাদা। 

ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার স্থল সীমান্ত আছে। ইউক্রেন ইউরোপের দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় দেশ। কিন্তু তাইওয়ান আকারে ছোট এবং এটি একটও দ্বীপ রাষ্ট্র। রাশিয়ার সেনাবাহিনী আকারে ছোট কিন্তু তাদের টেকনোলজি আধুনিক কিন্তু চীনের সেনাবাহিনী আকারে বড় কিন্তু তাদের টেকনোলজি অতটা উন্নত নয়। সেজন্য তাইওয়ান তার নিজস্ব ডিফেন্স নীতি নিয়েছে। তাইওয়ানের এই পরকিউপাইন নীতি পুরোপুরি বোঝবার আগে প্রথমে চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে সামরিক ক্ষমতার একটি তুলনা জানা দরকার। 

সত্যি কথা বলতে কী চীন ও তাইওয়ানের কোন তুলনা সম্ভবই না কারন চীন তাইওয়ানের থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী। প্রতিরক্ষা বাজেট, সামরিক ক্ষমতা, সেনা বল সবেতে চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। চীন বিশ্বের সবচেয়ে বেশী জনসংখ্যার দেশ সেজন্য তাদের সেনাসংখ্যাও অনেক কিন্তু সেই তুলনায় অনেক ছোট তাইওয়ানের তার জনসংখ্যার হিসাবে যথেষ্ট শক্তিশালী সেনাবাহিনী আছে। একটা কথা মনে রাখা দরকার ইতিহাসে বারবার যুদ্ধে চীন সবসময় পরাজিতই হয়েছে। আঠারো শতক বা উনিশ শতক সবসময় যুদ্ধে চীনের পরাজয়ই হয়েছে। ১৯৬২ সালের ইন্দো চীন যুদ্ধেও যদি জহরলাল নেহেরু ভারতীয় বায়ুসেনাকে আদেশ দিত তাহলে যুদ্ধের ফলাফল অন্যরকম হত। আসলে আকারে ছোট হলেও তাইওয়ানের যুদ্ধাস্ত্র চীনের তুলনায় অনেক আধুনিক। ১৯৬০ এর দশকে আকারে অনেক ছোট ইসরায়েলও মাত্র ছয়দিনে আরব দেশ গুলোকো পরাজিত করেছিল। চীনের জনসংখ্যা ১৩৯ কোটি, সেখানে তাইওয়ানের জনসংখ্যা ২.৩৬ কোটি। চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট যেখানে ২৩০ বিলিয়ন ডলার সেখানে তাইওয়ানের মাত্র ১৭ বিলিয়ন ডলার। চীনের স্থলসেনা প্রায় ২০ লাখ কিন্তু তাইওয়ানের মাত্র ১ লাখ ৭০ হাজার। কিন্তু তাইওয়ানের রিজার্ভ সেনা প্রায় ১৫ লাখ যেখানে চীনের প্রায় ৫ লাখ। চীনের ট্যাঙ্ক ৫,২৫০, সেখানে তাইওয়ানের ১,১১০. চীনের আর্টিলারি ফোর্স ৫,৮৫৪ সেখানে তাইওয়ানের ১৬৬৭. এবার চীনের মোট সেনা ও রিজার্ভ সেনা মিলিয়ে হচ্ছে ২৫ লাখ সেখানে তাইওয়ানের মোট সেনা ১৭ লাখ। মানে শুধু ভাবুন ছোট দেশ হয়েও কী বিশাল সেনা তাইওয়ানের। যদি বায়ুসেনার কথা বলা হয় তাহলে চীনের ৩২৮৫ বিমান রয়েছে যেখানে তাইওয়ানের মাত্র ৭৪১ টি বিমান রয়েছে। চীনের যুদ্ধ জাহাজ আছে ৭৭৭ সেখানে তাইওয়ানের মাত্র ১১৭. আর্মড গাড়ি, হেলিকপ্টার, ড্রোন সব চীনের অনেক বেশী আছে তাইওয়ানের তুলনায়। সাবমেরিন চীনের আছে ৭৯ টি সেখানে তাইওয়ানের মাত্র ৪ টি।

এবার আসা যাক তাইওয়ানের সজারু নীতির ব্যাপারে। কোন দেশ ছোট বলেই যে হেরে যাবে এমন কোন ব্যাপার নয়। রাশিয়া এতদিন ধরেও ইউক্রেনের কিছু করতে পারেনি। ইউক্রেনের তুলনায় তাইওয়ান অনেক বেশী শক্তিশালী দেশ। এখানে চিনের কী অবস্থা হবে ভেবে দেখুন। ১৯৫৫ সালে আমেরিকা যখন ভিয়েতনামে গিয়েছিল তারাও ভেবেছিল সহজেই হারিয়ে দেবে ভিয়েতনামকে কিন্তু ২০ বছর পর আমেরিকা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ভিয়েতনামীরা সুরঙ্গ করে এত ভয়ংকর গেরিলা যুদ্ধ করে আমেরিকার কিছু করার ছিল না। ঠিক তেমনি তাইওয়ানের সেনাবাহিনী উচ্চ প্রশিক্ষিত। তাইওয়ান জানে চীন যেকোনও মহূর্তে তাদের আক্রমন করতে পারে সেজন্য তারা প্রস্ততি নিয়েই রেখেছে। চীনের তুলনায় তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা বাজেট অনেক কম, চীনের মোট বাজেটের ১০ ভাগও নয়। সেজন্য তাইওয়ানকে তার প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম হিসাব করে কিনতে হয়েছে। তাইওয়ান ট্যাঙ্ক কেনেনইনি তেমন কারন এখন যুদ্ধে ট্যাঙ্কের ভূমিকা খুব কম। তাইওয়ানের যুদ্ধ জাহাজও বেশী নেই কারন চীনের এত সাবমেরিনের সামনে টিকতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা চীনের যে এত বিশাল স্থলসেনা, ইনফ্রন্টি, ট্যাংঙ্ক, আর্টিলারি এসব কীছুই তাইওয়ানের বিরুদ্ধে কাজে আসবে না। কারন যুদ্ধের পরিস্থিতি অনুযায়ী রোল ঠিক হয়। যেমন ভারতের লাদাখে যদি যুদ্ধ হয় ভারত ও চীনের সেখানে ভারতীয় বায়ুসেনা ও স্থলসেনা যুদ্ধ করবে, নেভির কোন ভূমিকা থাকবে না। 

আবার ভারত মহাসাগরের যুদ্ধে নেভিই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবে। ঠিক তেমনি তাইওয়ান দ্বীপ রাষ্ট্র হওয়ায় এখানে যুদ্ধ হবে মূলত দুইদেশের বায়ুসেনা ও নৌসেনার মধ্যে। এখানে চীনের বিশাল স্থলসেনার গুরুত্ব নেই। কিন্তু তাইওয়ান তাদের ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি, স্থলসেনা কাজে লাগাতে পারবে কারন চীন তাইওয়ানে আসছে যুদ্ধ করতে সেজন্য এখানে চীন অনেক বড় সমস্যায় পড়বে। তাইওয়ান বিগত কয়োক বছর ধরে প্রচুর জ্যাভেলিন, স্ট্রিংগার মিসাইল কিনেছে আমেরিকা থেকে। মিলিটারি মাইনের উপর গবেষনা তাইওয়ানের মতন কোন দেশ হয়ত বিশ্বে করেনি। তাইওয়ান এমন জাহজ তাদের নৌবাহিনীতে যুক্ত করেছে যেগুলো অত্যন্ত দ্রুত গতির এবং সমুদ্রে মাইন লাগাতে পারদর্শী। চীন যদি তাইওয়ানের উপকূলে এগোয় এই মাইনের আঘাতে চীনের অনেক সেনা, যুদ্ধজাহজ ধ্বংস হয়ে যাবে। যদি কোনওরকমে চীনা সেনা তাইওয়ান উপকূলে এসেও পৌঁছায় তাহলেও বিপদ। গোটা উপকূল জুড়ে তাইওয়ান মাইন বিছিয়ে রেখেছে। ভারত যদি যুদ্ধ করে তাহলে আমরা মনে করি এক ইঞ্চি জমিও দেবো না কিন্তু তাইওয়ান একটু আলাদা ভাবে। তাইওয়ান চীনকে আগে আসতে দেবে, চীন হয়ত তাইওয়ানের এক স্কোয়ার কিলোমিটার জায়গা দখল করল কিন্তু এর বদলে তাইওয়ানের মাইনে ও মিসাইলের আঘাতে চীনের ৪-৫ হাজার সেনা মারা যাবে। অর্থাৎ তাইওয়ানের নীতি এটাই যে চীন হয়ত তাদের হারিয়ে দেবে কিন্তু চীন নিজেও ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লাখ লাখ চীন সেনার মৃত্যু হবে। এবার চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং কী করে সেটাই দেখার। কারন এদিকে ভারত, অন্যদিকে জাপান, আমেরিকা সবারই নজর আছে চীনের উপর। তবে এটা ঠিক যে চীন যদি যুদ্ধ করে তাহলে ৩০-৪০ বছরে চীনের যা অগ্রগতি তা অনেকটাই থমকে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *