ডিফেন্স

তবে কী খাদ্য সংকটের জন্যই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতে পারে?

রাজেশ রায়:— কিছুদিন আগে একটা খবর শুনে থাকবেন যে ভারত আন্তর্জাতিক বাজারে গম বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। শুধু তাই নয় আন্তর্জাতিক ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট বা আইএফপিআই এর তথ্য অনুযায়ী ভারত সহ ১৪ টি দেশ গম, চিনি ও পাম তেলের মতন গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য সামগ্রী বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এর ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন দেশে খাদ্য সংকট দেখা যায় ও খাদ্য দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানিয়েছে ২০২০ এর মে থেকে ২০২২ এর ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য মূল্য অন্তত ৫৫.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার জন্য পেরু, চিলি, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরানের মতন অনেক দেশে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে। দক্ষিন আমেরিকার ইকুয়েডর নামক দেশে সরকারের বিরুদ্ধে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ এতটাই জোরালো যে দেশটির রাষ্ট্রপতিকে দেশটির কিছু প্রদেশে এমারজেন্সি জারি করতে হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এই খাদ্য সংকটের দুটি কারন বলছে প্রথমত আবহাওয়ার পরিবর্তন। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণয়নের কারনে খাদ্য উৎপাদনে সমস্যা হচ্ছে এবং বিশ্বে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির ফলে সেই তুলনায় প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে না যার কারনে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ অনাহারে ভুগছে। দ্বিতীয় কারন হিসাবে বলা হচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ। যার জন্য গম, বার্লি ও প্রয়জনীয় সারের জোগান বন্ধ হয়ে গেছে। 

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য পোগ্রামের প্রধান ডেভিড বিসলির কথায় যদি এমন অবস্থা থাকে তাহলে ভবিষ্যতে বিশ্বে বিশাল বিক্ষোভ শুরু হয়ে যাবে এবং লোক উন্নত দেশে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করবে এবং বিশ্বের সামাজিক অবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। কিছু বিশেষজ্ঞতো এটাও জানিয়েছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ খাদ্য সংকটের কারনেই শুরু হবে। বিশ্ব খাদ্য সংকট ও তার কারন সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হবে, সাথে এটাও বিশ্লেষণ করা হবে কী করে এই সংকট দূর করা সম্ভব হবে এবং সত্যিই কী খাদ্যের জন্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে পারে?

২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ৫৩ টি দেশের ১৯৩ মিলিয়ন লোক খাদ্য সংকটে ছিল, ২০২০ সালের তুলনায় এতে ৪০ মিলিয়ন লোক বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের মধ্যে ৩৬ টি দেশে ৪০ মিলিয়ন লোক সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। ইথিওপিয়া, মাদাগাস্কার, ইয়ামেন এবং দক্ষিন সুদান এই চারটি দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষই খাদ্য সংকটে ভুগছে। এছাড়াও বিশ্বজুড়ে ২৩৬ মিলিয়ন এমন লোক রয়েছে যারা এখনই খাবার না পেলে তীব্র খাদ্য সংকটে পড়বে ভবিষ্যতে। বিশ্বের যত মানুষ খাদ্য সংকটে ভোগে তার ৭০ শতাংশ মানুষ কেবল দশটি দেশে রয়েছে পাকিস্তান, হাইতি, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া, সুদান, দক্ষিন সুদান, ইয়ামেন, সিরিয়া ও কঙ্গো। এদের মধ্যে সাতটি দেশে খাদ্য সংকটের প্রধান কারন আভ্যন্তরীন ঝামেলা। গ্লোবাল নেটওয়ার্ক এগেইন্সট ফুড ক্রাইসিসের মতে আভ্যন্তরীণ ঝামেলা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং জলবায়ুর পরিবর্তন খাদ্য সংকট তৈরির প্রধান কারন। এগুলো এক এক করে বলা যাক। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর সাথে সাথে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বাড়ছে। যার কারনে নদী ও জলাশয়ের জল শুকিয়ে যাচ্ছে। শিল্প ও কৃষিকাজের দূষিত জল পানীয় জল নষ্ট করছে এবং অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানীয় জলের স্তর কমে যাচ্ছে। 

আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসার তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর জলের স্তর ক্রমশ কমছে। যার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন কম হচ্ছে। প্রতিবছর প্রচুর মাটি কাটার ফলেও ফসল উৎপাদনে সমস্যা হচ্ছে। একটি তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর ২০-৪০ বিলিয়ন টন চাষযোগ্য মাটি কাটা হয়। এছাড়া হিট ওয়েভ চাষের উপর প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য হিট ওয়েভ তৈরি হয় যা ফসলকে নষ্ট করে দেয়। ভারতে এই জন্য প্রতি বছর অনেক ফসল নষ্ট হয়। এবছরই হিটওয়েভের কারনে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশে প্রচুর গম নষ্ট হয়ে যায় যার জন্য সেখানকার কৃষকদের অন্তত ৪০-৬০ শতাংশ ক্ষতি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া উৎপন্ন হয় যা ফসলের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ২১০০ সাল পর্যন্ত জলবায়ুর পরিবর্তনে ভুট্টা উৎপাদন ২০-৪৫ শতাংশ, গম উৎপাদন ৫-৫০ শতাংশ, চাল উৎপাদন ২০-৩০ শতাংশ এবং সোয়াবিন উৎপাদন ৩০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাবে। সবথেকে বড় চিন্তার বিষয় ২১০০ সাল আসতে আসতে খাদ্য উৎপাদন যখন কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে যাবে তখন বিশ্বের জনসংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১১ বিলিয়ন বা ১১০০ কোটি হয়ে যাবে। এখন বিশ্বের নোট জনসংখ্যা প্রায় ৭৩০ কোটি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন মানব জাতির জন্য কী বিপদ আসতে চলেছে। 

বর্তমানে খাদ্য সংকটের উপর রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধ বড় প্রভাব ফেলছে। তবে এই যুদ্ধের আগেই বিশ্বে করোনা মহামারীর কারনে কয়েক কোটি মানুষ গরীব হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বে খাদ্য সংকটকে আরও বৃদ্ধি করেছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশী গম রপ্তানি করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। বিশ্বের মোট গমের ২৫ শতাংশই এই দুটি দেশ রপ্তানি করে। এছাড়া সানফ্লাওয়ার তেল, ভুট্টোও এই দুই দেশ রপ্তানি করে। জাতিসংঘের ফুড পোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী ইউক্রেন যুদ্ধের আগে পর্যন্ত বিশ্বে প্রায় ৫৫ মিলিয়ন মেট্রিকটন শস্য রপ্তানি করেছে কিন্তু যুদ্ধ শুরু হবার পর এবং রাশিয়া ব্ল্যাক সী আটকে দেবার পর থেকে সব রপ্তানি বন্ধ আছে যার প্রভাব পড়েছে পূর্ব ইউরোপ, মধ্য প্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশ গুলোর উপর কারন এসব দেশ গুলো তাদের ৫০ শতাংশ গম রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে কেনে। মিশর তার ৮০ শতাংশ গম আমদানির জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের উপর নির্ভর করে কিন্তু এখন মিশর বাধ্য হয়ে ভারত থেকে গম কিনছে। 

পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য প্রাচ্যের দেশ গুলো বাধ্য হয়ে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা থেকে খাদ্য শস্য কিনছে কিন্তু পরিবহন খরচ অতিরিক্ত হওয়ায় খাদ্যের দাম প্রচুর বেড়ে গেছে। ভারত মূলত রাশিয়া থেকে সানফ্লাওয়ার তেল কেনে কিন্তু এখন তাও বন্ধ আছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে বিশ্ব জুড়ে খাদ্য সংকটের কারনে অনেক দেশ তাদের খাদ্য দ্রব্য বিক্রিই করছে না। আন্তর্জাতিক ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত ২০ টি দেশ তাদের খাদ্য দ্রব্য রপ্তানিতে বিশেষ লাইসেন্স ও অতিরিক্ত কর আরোপ করেছে এবং ১৪ টি দেশ তাদের অনেক দ্রব্য বিক্রি বন্ধ রেখেছে। ভারত ও গম রপ্তানি এবং ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত চিনি বিক্রি বন্ধ রেখেছে। ভারত চিনি উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে এবং ব্রাজিলের পর ভারত দ্বিতীয় সবচেয়ে বেশী চিনি রপ্তানি কারক দেশ। ভারত চিনি বিক্রি বন্ধ রেখেছে যাতে দেশের চিনির পর্যাপ্ত যোগান থাকে এবং চিনির মূল্য নিয়ন্ত্রিত থাকে। ভারতের মতো মালয়েশিয়া মুরগী বিক্রি বন্ধ রেখেছে যার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে তাদের প্রতিবেশী সিঙ্গাপুরের উপর। সিঙ্গাপুর তাদের এক তৃতীয়াংশ মুরগী মালয়েশিয়া থেকে ক্রয় করে ফলে সিঙ্গাপুরে মুরগীর দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। এসব কারনে গোটা বিশ্বেই খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ব্যাপক বেড়ে গেছে। এতে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে গরীব ও মধ্যবিত্ত সমাজের লোকেরা।

খাদ্য সংকটের ফলে হিংসা ও যুদ্ধের সম্ভবনা বেড়ে যায় অনেক। ইতিহাসে রুটি, আটা এমনকী আলুর জন্যও লড়াই হয়েছে। ফরাসী বিপ্লবের পেছনেও খাদ্য সংকট কিছুটা দায়ী ছিল। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসের মানুষ যখন বাস্তিল দুর্গ আক্রমন করেছিল তখন তারা গমের ভান্ডার লুট করছিল, এখনকার অবস্থা তখনের থেকেও খারাপ। এক অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞান লেখক জুলিয়ান ক্রিবস তার বই খাদ্য এবং যুদ্ধে বলেছেন এর আগে মানব জাতিকে খাদ্যের জন্য এতটা সংকটে কোনওদিন পড়তে হয় নি। বিশ্ব ব্যাঙ্ক জানিয়েছে এই সমস্যা দূর করতে এখন থেকে খাদ্য উৎপাদন পক্রিয়া ৫০ শতাংশ বাড়াতে হবে। ওহিও ইউনিভার্সিটির সোশিওলজির অধ্যাপক স্টিফেন স্ক্যানল্যান জানিয়েছেন পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সরকারের এই মহূর্তে উচিৎ খাদ্যকে মৌলিক অধিকার হিসাবে ঘোষণা করা এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের মধ্যে খাদ্যের সুষম বন্টন দরকার এবং এর জন্য প্রতিটি দেশের যৌথ ভাবে আলোচনা করে কোন পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার অধ্যাপক উষা হ্যালে জানান ভবিষ্যতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ খাদ্যের জন্য হতে পারে। 

বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছে প্রতিটি দেশের সামরিক ব্যায় অন্তত ২০ শতাংশ কম করা দরকার এবং সেই অর্থ উন্নত প্রযুক্তিতে খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহার করা দরকার যাতে ভবিষ্যতে ১১ বিলিয়ন লোকের জন্য খাদ্য মজুত থাকে। ২০২১ এর গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে বিশ্বের ১১৬ টি দেশের তালিকায় ভারত ১০১ স্থান পায়, ২০২০ সালে ভারত ছিল ৯৪ তম স্থানে। যা প্রমান করে ভারতেও খাদ্য সংকট রয়েছে। পর্যাপ্ত ফসল উৎপাদন সত্বেও ভারতে ১৪ শতাংশ লোক অপুষ্টিতে ভুগছে যা সত্যিই চিন্তার বিষয়। ভারতের কৃষিকাজ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ এ ভারতে ৩১৪.৫১ মিলিয়ন মেট্রিকটন ফসল উৎপাদন হয়েছে যা ১৩০ কোটি ভারতবাসীর জন্য যথেষ্ট। এটা প্রমান করে ভারতে খাদ্য সংকট কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা হয়েছে ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের অদক্ষতায়। তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর ভারতে ৬৭ মিলিয়ন মেট্রিকটন ফসল নষ্ট হয়ে যায় যা গোটা ব্রিটেনের এক বছরের ফসল উৎপাদনের সমান। বিপিএল কার্ড না থাকার জন্য অনেক গরীব মানুষ সরকারের দেওয়া খাদ্য দ্রব্যের লাভ ওঠাতে পারে না। যদি ভারতে খাদ্য দ্রব্য সুষম ভাবে বন্টন করা হয় তাহলে ভারতে কোনওদিন খাদ্য সংকট তৈরিই হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *