ছয় বছরে মোট ছয়বার জেলে পাঠানো হয়। প্যাটেলই একমাত্র জাতীয় নেতা যিনি গান্ধীর সাথে দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর সাথে জেলে সময় কাটিয়েছিলেন
আমরা ভারতীয়রা সর্দার প্যাটেলের কৃতিত্ব বলতে শুধু ১৯৪৭ সালের কথাই মনে রাখি। তবে, ওই বছর ছাড়াও তার সম্পর্কে বলার মতো রয়েছে কিন্তু অনেক কথাই।
১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় প্যাটেল কংগ্রেসের প্রধান নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। নির্বাচনের জন্য তহবিল সংগ্রহ, প্রার্থী নির্বাচন থেকে শুরু করে একজন শক্তিশালী কংগ্রেস নেতা হিসাবে নেহরুর আবেদনকে সমর্থন করার জন্য জানপ্রাণ লড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে নিয়ে কথা উঠলে বেশির ভাগ মানুষই তাকে মনে রেখেছেন কেবলমাত্র ভারতীয় ইউনিয়নের অভ্যন্তরে ৫৬২ টি রাজ্যের একীকরণের জন্য। এই দুঃসাধ্য কাজটি সম্পন্ন করা নিঃসন্দেহে তার সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব কিন্তু প্যাটেলের অর্জিত এই সাফল্যকে ক্ষুণ্ণ না করেও জোর দিয়ে বলছি, আমাদের কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যেই ন্টিগ্রেশনের এই কাজটি তার ৭৫ বছরের দীর্ঘ জীবনের মাত্র শেষ কয়েক বছর দখল করে রেখেছে। এর আগের সাত দশকেও তিনি ভারতের জন্য নেহাত কম কিছু করেননি। অথচ আজ এই দেশ নেতার অধিকাংশ স্মৃতিই ভুলে গেছে। জনসাধারণের স্মৃতির অগোচরে চলে গেছে তার বহু কৃতিত্ব। ভুলে গেছি আমরা এই মহান নেতাকে।
লন্ডন থেকে আগত এই ব্যারিস্টার আহমেদাবাদের বিখ্যাত ক্রিমিনাল লয়ার হওয়ায় কোনোদিনই তিনি নিজের পেশা ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান করার কথা ভাবেননি। তবে, গান্ধীজির সহজ সরল নীতি এবং অভিনব রাজনীতি তাঁকে ভীষণ ভাবেই আকৃষ্ট করেছিল। বলা যেতে পারে তার হাত ধরেই শুরু হয় প্যাটেলের রাজনৈতিক জীবন। ১৯১৮ সালে অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় ভূমি কর নীতির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের ডাকা খেদা সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণের পর থেকেই তিনি ক্রমশ গান্ধীজির ঘনিষ্ঠ সহযোগীতে হয়ে উঠেছিলেন। প্যাটেল তখন ছিলেন ৪৩ বছর বয়সী এক বিপত্নীক। খেদা অভিযানের পরে, গান্ধী স্বয়ং প্যাটেলকে নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, “আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে খেদা আন্দোলনের সময় যখন প্রথমবারের জন্য বল্লভ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয় তখন বলিষ্ঠ চেহারার এই ব্যক্তির পরিচয় জানার জন্য মনে জেগে উঠেছিল নানা প্রশ্ন এবং একই সাথে আমি যে ভাবে চাই ঠিক সেরকম ভাবেই তিনি আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন কিনা সে নিয়েও আমার মনে ছিলো নানা সন্দেহ। তবে, যতদিন কেটেছে, তাকে যত ভালো করে চিনতে পেরেছি, আমি ততই বুঝতে পেরেছি যে তার সাহায্য আমার প্রয়োজন….যদি তার সহায়তা না থাকত,তবে সত্যি বলতে আজ আমাদের অভিযান এতো সফলভাবে সম্পন্ন হতো না।”
প্যাটেল গান্ধীর মধ্যে স্বাধীন ভারতকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো একজন যোগ্য নেতাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। যিনি একই সাথে সাহসী, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং উদ্ভাবনী ছিলেন। প্যাটেল নিজে দার্শনিক আলোচনায় খুব একটা বেশি একটা আগ্রহী না হলেও,গান্ধীর কাছ থেকে বিনা দ্বিধায় চরকা, খাদি, অহিংস কৌশল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের মতো বিষয়গুলো নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পরে সংঘটিত হওয়া আন্দোলনগুলোতে বারংবার প্রমাণিত হয়েছিলো যে প্যাটেল একাধারে যেমন একজন চমৎকার সংগঠক এবং কার্যকর প্রশাসক ছিলেন তেমনি অপরদিকে ছিলেন একজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সৈনিক। মাটিতে শক্তভাবে পা রেখে চলা একজন দক্ষ সেনাপতি ছিলেন তিনি।
স্বাধীনতা পূর্ব ভারতীয় রাজনীতিতে অগণিতবার নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। গুজরাটের বাইরে প্যাটেলের নেতৃত্বের সম্প্রসারণ প্রথম লক্ষ্য করা যায় ১৯২৩ সালে নাগপুর পতাকা সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময়। আবার ওই একই বছর শাস্তিমূলক করের বিরুদ্ধে বোরসাদ সত্যাগ্রহের সময় গান্ধীর অহিংস শক্তির একজন যোগ্য সেনাপতি হিসেবে স্বাধীনভাবে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি। সি. রাজাগোপালাচারী নাগপুর পতাকা সত্যাগ্রহের পর প্যাটেলের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, “মি. বল্লভভাইকে নাগপুরে যে কাজের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল তা একাধারে ছিলো যেমন কঠিন তেমনি ভীষণ রকমের একঘেয়ে লাগার মতোও। এর পরেও তিনি সমগ্র কাজটি যেরকম আভিজাত্য ও মননশীলতার সাথে পালন করেছেন তা সত্যিই অতুলনীয়। সংগ্রাম চলাকালীন যারা যুদ্ধে নেমেছিলেন তাদের প্রত্যেকে প্রমাণ করেছিলেন যে তাদের লড়াইয়ের পদ্ধতি যতটা সচ্ছ ছিলো পৃথিবীর আর কোনো যুদ্ধে কোনোকালে এতটা সচ্ছতা বজায় রাখা হয়নি। বল্লভভাই নিজের ওপর যাবতীয় দায়িত্ব নিয়ে প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন যে কোনো রকম হিংস্রতা ছাড়াই সম্পূর্ণ সচ্ছ উপায়ে লড়েও জয় আনা সম্ভব।
১৯২৮ সালে ভূমি রাজস্বের সংশোধিত আইনের বিরুদ্ধে বারদোলিতে সফল সত্যাগ্রহ প্যাটেলকে জাতীয় খ্যাতি এনে দিয়েছিল। গান্ধীজি স্বয়ং স্বীকার করেছিলেন যে বোরসাদ এবং বারদোলি উভয় সত্যাগ্রহই সম্পন্ন হয়েছিলো কেবলমাত্র প্যাটেলের নেতৃত্বের কারণে। আর এই বারদলী সত্যাগ্রহের প্রভাব সেই সময় পড়েছিলো সমগ্র দেশব্যাপী। মুন্সি প্রেমচাঁদ ১৯৩০ সালে তাঁর ম্যাগাজিন হাঁসের নভেম্বর সংখ্যায় বীরভূমি বারদোলি [বরদোলি-বীরের দেশ] শিরোনামের একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। উল্লেখ্য এই বারদোলি সত্যাগ্রহই কিন্তু প্যাটেলকে তার বিখ্যাত সর্দার উপাধিটি এনে দিয়েছিল। তিনি ১৯৩১ সালে একবার কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু, গান্ধীর পরামর্শে দু-বারই তিনি সেই পদ থেকে সরে এসেছিলেন।
প্যাটেলকে স্বাধীনতা আন্দোলনের জেরে নেহাত কম বার যেতে হয়নি জেল। ছয় বছরে মোট ছয়বার জেলে পাঠানো হয় তাকে। এরই মধ্যে একবার ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে এবং গান্ধীজি-কে মহাদেব দেশাইয়ের সাথে প্রায় ১৫ মাসের জন্য ইয়েরওয়াদা জেলে কারাবাসে পাঠিয়েছিলো। প্যাটেলই সম্ভবত একমাত্র জাতীয় নেতা যিনি সেই সময় গান্ধীর প্রত্যক্ষ নজরে এসে তার সাথে একত্রিত হয়ে বেশ কয়েকটি সত্যাগ্রহ আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন এবং এত দীর্ঘ এক সময় ধরে তাঁর সাথে জেলে সময় কাটিয়েছিলেন।
বিখ্যাত লবণ আন্দোলনের ঠিক আগেই প্যাটেলকে যখন প্রথমবার জন্য কারাগারে বন্দী করা হয়,তখন গান্ধীজি স্বয়ং একটি নিবন্ধে প্যাটেলের মানব সেবার কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন “কেন সর্দার প্যাটেল গুজরাটের মানুষের কাছ থেকে আশা রাখবেন না? তিনি কি শ্রমিকদের সেবা করেননি? ডাক কর্মচারী ও রেলের কর্মচারীরা কি তার কাছ থেকে স্বরাজের শিক্ষা নেয়নি? আহমেদাবাদের কোন বাসিন্দা শহরের প্রতি তার সেবা এবং আত্মত্যাগের কথা সম্পর্কে অবগত নন? বল্লভভাই- ই একা এমন এক ব্যক্তি যিনি প্লেগের সময় অসুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা থেকে শুরু করে খরার সময় অন্ন দিয়ে অভুক্তদের সাহায্য করেছিলেন, মহা বন্যার সময় গুজরাটে মানুষের এতো সেবা করেছিলেন, ত্রাণ কাজের জন্য সরকারের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, পূর্ণ স্বরাজের চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য মানুষকে প্রস্তুত করেছিলেন এমনকি সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কারাগারে অব্দি পৌঁছেছেন…”
কংগ্রেসে প্যাটেলের ভূমিকা নিয়ে আলাদা করে আরো কিছু কথা না বললেই নেহাত নয়।প্যাটেল প্রথম দিকে কংগ্রেসের আহমেদাবাদ-ভিত্তিক এক নেতা হিসাবে নিজের রাজনৈতিক জীবন শুরু করলেও শীঘ্রই নিজেদের কর্মক্ষমতার দ্বারা ১৯২১ সালের মধ্যে গুজরাটে কংগ্রেসের প্রাদেশিক কমিটির প্রথম সভাপতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। সেই সময় ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে কংগ্রেসের কোনো রকম রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকলেও তিনি তার মধ্যেই অত্যন্ত সফল এক তহবিল সংগ্রহকারী হিসেবে বিখ্যাত হতে ওঠেন। তিনি তিলক স্বরাজ তহবিল, গুজরাট বিদ্যাপীঠ, ত্রাণ কাজ সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন প্রায় লক্ষ লক্ষ টাকার।
১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ ভারতে প্রথমবারের মতো প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় প্যাটেল ছিলেন কংগ্রেসের অন্যতম এক প্রধান শক্তি। একা হাতে বহু কাজ সামলে ছিলেন তিনি ওই কঠিন সময়। তহবিল সংগ্রহ করা, প্রাদেশিক নির্বাচনের জন্য প্রার্থী নির্বাচন করা থেকে শুরু করে নেহেরুর জনপ্রিয় গণ আবেদনকে সমর্থন করার মাধ্যমে কংগ্রেসের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জনপ্রিয় এক প্রতিনিধি। নেহেরু এবং প্যাটিলের মধ্যে কখনো যে মতবিরোধ হয়নি এমনটা কিন্তু মোটেই নয়। তবে,মাঝে মাঝে মতাদর্শের কিছু পার্থক্য আর মতবিরোধ হওয়া সত্ত্বেও তাদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিলো সব সময় অটুট। বয়সের অনেকটা তফাৎ থাকা সত্ত্বেও গান্ধীজির আদর্শে দীক্ষিত আবেগপ্রবণ,আদর্শবাদী জওহরলাল নেহেরু এবং ১৪ বছর বয়স্ক বাস্তববাদী, গ্রাউন্ডেড প্রশাসক প্যাটেল দেশের প্রতি নিজেদের নৈতিক কর্তব্যর সূত্রে একে অপরের সাথে সর্বদা যুক্ত ছিলেন। তারা গান্ধীর স্বরাজ আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিলেন। এখনো ১৯৪২ সালের অগাস্ট মাসে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিখ্যাত ছবি ভারতবাসীর মনে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে – যেখানে গান্ধী প্যাটেল এবং নেহেরু একত্রে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কংগ্রেসের পুরো শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো প্যাটেলকেও। জানা যায় গ্রেফতারির পর ১৯৪২ সালে তাকে আহমেদনগর ফোর্ট জেলে পাঠানো হলে পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৩ সালের ১জুলাই পাটেল তার পুত্রবধূ ভানুবেনকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন “…যতক্ষণ না ঈশ্বর আমাকে নিজের কাছে টেনে নিচ্ছে ততক্ষণ আমি এখানেও ঠিক টিকে যাবো। কিন্তু, হঠাৎ করে তার এলেও মনে প্রাণে প্রস্তুত আমি। আমার জীবনের কাজ ফুরোলে আমাকে যেমন ইহলোক চেটে চলে যেতে হবে তেমনি, কিছু কাজ বাকি থাকলে নিশ্চয়ই থাকব আমি। কে জানে কোনটা হবে?… আমার বয়স এখন ৬৯ ছুঁয়েছে। জীবনে যা করা উচিত তাই করেছি। আমি যাকে মনেপ্রাণে আমার ধর্ম বলে মনে করেছি তা পালন করতে করতে যদি ঈশ্বরের কাছে আমার ডাক পরে যায় তবে এর চেয়ে ভাল আর কী-ই বা হতে পারে?…”
কিন্তু, প্যাটেল তখনও জানতেন না যে তার জীবনের দীর্ঘ বিস্তৃত এক পর্ব বাকি রয়েছে এখনো। তার জীবনের সাথে সমার্থক হয়ে উঠবে যে কাজটি তা তখনও তার জন্য অপেক্ষা করছিল কারাগারের বাইরে।