ডিফেন্স

ভারতবর্ষের হাতে থাকা চীন, পাকিস্তানের ত্রাসের কারন রাশিয়ার তলোয়ার ক্লাস যুদ্ধজাহাজ। কি এমন যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে ফ্রিগেটতে?

রাজেশ রায় : ভারতীয় নৌবাহিনীতে সার্ভিসে থাকা একটি শক্তিশালী ফ্রিগেট হচ্ছে তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেট। এটি রাশিয়ান ফ্রিগেট। প্রজেক্ট ১১৩৫৬ বা তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেট রাশিয়ান ক্রিভক ৩ বা প্রজেক্ট ১১৩৫ এর আপগ্রেডেড ভার্সন। তলোয়ার নামটি ভারত দিয়েছে। এই তলোয়ার ক্লাসেরই সেম ক্লাস বা আপগ্রেডেড ভার্সন হচ্ছে অ্যাডমিরাল গ্রিগরভিচ ক্লাস ফ্রিগেট। সোজা কথায় অ্যাডমিরাল গ্রিগরভিচ ক্লাস তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেটই কিন্তু পূর্বের ভার্সনের তুলনায় একটু আপগ্রেডেড। আজ আমরা ভারতীয় নেভিতে যুক্ত থাকা এই তলোয়ার ক্লাস বা অ্যাডমিরাল গ্রিগরভিচ ক্লাস ফ্রিগেট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। 

রাশিয়া বা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭০ এর দশক থেকেই ক্রিভক ক্লাস ফ্রিগেট তৈরি করে আসছে। প্রথমের দিকে এগুলো অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার স্পেশালিস্ট হিসাবেই কাজ করত পরে এগুলোকে ফ্রিগেটের ভূমিকায় ব্যবহার করা হয়। ক্রিভক ক্লাস ফ্রিগেটের চারটে ভার্সন রয়েছে ক্রিভক ১, ক্রিভক ২, ক্রিভক ৩, ক্রিভক ৪. সোভিয়েত ইউনিয়ন ৪০ টির মত ক্রিভক ক্লাস ফ্রিগেট তৈরি করেছিল। রাশিয়ার সেভারনয়ে ডিজাইন ব্যুরো পুরোনো ক্রিভক ক্লাসের উপর বেসড করে নতুন ডিজাইন করে, যার নাম হয় প্রজেক্ট ১১৩৫.৬.  ভারত ও রাশিয়ার বন্ধুত্বের সম্পর্ক বহু পুরোনো সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় থেকে। ভারতের নজরে অনেকদিন ধরেই এই ফ্রিগেট গুলোর উপর ছিল। আসলে ভারত সেইসময় শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেট প্রজেক্ট শুরু করেছিল, এদিকে ভারতীয় নৌবাহিনীতে যুক্ত থাকা পুরোনো লিয়েন্ডার ক্লাস ফ্রিগেট গুলো অবসরে যাবার সময় হয়ে আসছিল। তাই ভারতীয় নেভি তাদের ফ্লীট ঠিক রাখতে ক্রিভক ক্লাস ফ্রিগেট কিনবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৭ সালের ১৭ নভেম্বর  ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে তিনটি ক্রিভক ৩ ক্লাস ফ্রিগেট কেনার চুক্তি হয় ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে। এরপর রাশিয়ান সেভারনয়ে ডিজাইন ব্যুরো ও জাহাজ নির্মান সংস্থা বাল্টিস্কাই জাভোড সেন্ট পিটাসবার্গে কনস্ট্রাকশন শুরু করে। এই জাহাজের সম্পূর্ণ ডিজাইন তৈরি করতে রাশিয়ার প্রায় ৩০ টি ডিজাইন সংস্থা ও ইন্সটিটিউট অংশ নিয়েছিল এবং জার্মানি, ভারত, রাশিয়া, ব্রিটেন, ডেনমার্ক, বেলারুশ, ইউক্রেনের প্রায় ১৩০ টি সাপ্লায়ার এই প্রজেক্টে যুক্ত ছিল। পরে ১৪ জুলাই ২০০৬ সালে ভারত সরকার আরও তিনটি ক্রিভক ৩ ফ্রিগেট অর্ডার দেয়। এগুলো তৈরি হয় রাশিয়ার কালিনগ্রাদে ইয়ান্তর শিপইয়ার্ডে। তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেট রাশিয়া ভারতীয় নেভির জন্যই স্পেশালি ডিজাইন করেছে। তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেটের প্রথম তিনটি ফ্রিগেট ডেলিভারি দিতে রাশিয়া ১৩ মাস, ৭ মাস ও ১১ মাস দেরী করেছিল। ২০১৬ সালে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে ২.৫ বিলিয়ন ডলার বা ১৮,৭০০ কোটি টাকার বিনিময়ে চারটি আপগ্রেডেড তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেট বা অ্যাডমিরাল গ্রিগরভিচ ক্লাস ফ্রিগেটের চুক্তি হয়। যার দুটি রাশিয়ার কালিনগ্রাদে ইয়ান্তার শিপইয়ার্ডে ও দুটি ভারতের গোয়া শিপইয়ার্ডে তৈরি হচ্ছে। একে ক্রিভক ৪ ক্লাস ফ্রিগেট ও বলা হয়। ভারতের পাশাপাশি রাশিয়া নিজের ব্ল্যাক সী ফ্লীটের জন্যও ছয়টি অ্যাডমিরাল গ্রিগরভিচ ক্লাস ফ্রিগেট অর্ডার দিয়েছে। এই মহূর্তে ভারতীয় নৌসেনায় ছয়টি তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেট রয়েছে। প্রথম তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেট আইএনএস তলোয়ার ১৮ ই জুন ২০০৩ সালে ভারতীয় নোভিতে সার্ভিসে আসে। দ্বিতীয় তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেট আইএনএস ত্রিশূল ২০০৩ সালের ২৫ জুন নেভিতে যুক্ত হয়। তৃতীয় জাহাজ আইএনএস তাবার ২০০৪ সালের ১৯ এপ্রিল ভারতীয় নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়। চতুর্থ জাহাজ আইএনএস তেগ ২০১২ সালের ২৭ এপ্রিল ভারতীয় নেভিতে যুক্ত হয়। পঞ্চম জাহাজ আইএনএস তারকাশ ৯ নভেম্বর ২০১২ সালে এবং ষষ্ঠ জাহাজ আইএনএস ত্রিখন্ড ২৯ জুন ২০১৩ সালে ভারতীয় নেভিতে যুক্ত হয়। এই মহূর্তে রাশিয়ার ইয়ান্তার শিপইয়ার্ডে দুটি তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেট আইএনএস তুশিল ও আইএনএস তামালা তৈরি হচ্ছে যা ২০২৪ সালে ভারতীয় নেভিতে যুক্ত হবে। গোয়া শিপইয়ার্ডে লাস্ট দুটি জাহাজ তৈরি হচ্ছে যার একটি আইএনএস ত্রিপুট ও আরেকটির নাম এখনও ঠিক হয় নি। সপ্তম তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেট আইএনএস তুশিল রাশিয়ার মস্কোতে গত ২৮ অক্টোবর ২০২১ এ ভারতীয় অ্যাম্বাসেডর ডি বালা ভেঙ্কটেশ বর্মা, ভারতীয় ও রাশিয়ান নেভি অফিসিয়ালদের উপস্থিততে লঞ্চ করা হয়েছে। সংস্কৃত শব্দ তুশিল শব্দের অর্থ “প্রোটেক্টর শিল্ড” অর্থাৎ বিপদ থেকে রক্ষা করার কবচ।

প্রায় ১২৫ মিটার লম্বা ও ১৫ মিটার চওড়া তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেটের মোট ডিসপ্লেসমেন্ট ৩,৮৫০ টন। এতে ইঞ্জিন হিসাবে রয়েছে ইউক্রেনের তৈরি জোরিয়া ম্যাশপ্রকেট এম৭এন ১ই গ্যাস টার্বাইন ইঞ্জিন, ২ টি ডিএস ৭১ ক্রুইজ গ্যাস টার্বাইন যা ৭,৩৫০ কিলোওয়াট শক্তি উৎপন্ন করে এবং ২ টি ডিটি-৫৯ বুস্ট গ্যাস টার্বাইন যা ১৬,৫৪৩ কিলোওয়াট শক্তি উৎপন্ন করে। কিন্তু ২০১৭ সালে হওয়া রাশিয়া ইউক্রেন ঝামেলার জন্য ইউক্রেন কোন রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজের জন্য ইন্জিন সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়। তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেটের প্রধান ইঞ্জিন জোরিয়া ম্যাশপ্রকেট তৈরি করে ইউক্রেন। যার জন্য ভারত পড়ে বিপদে, কারন ভারতের অর্ডার দেওয়া অ্যাডমিরাল গ্রিগরভিচ ক্লাস ফ্রিগেটে এই ইন্জিনই ব্যবহার করা হয়। যার জন্য ২০১৭ সালে ডিফেন্স অ্যাকুইজেশন কাউন্সিল ইউক্রেনের থেকে আালাদা ভাবে ৪৯০ কোটি টাকার বিনিময়ে দুটি ইন্জিন কেনে। একটানা ৩০ দিন অপারেশনাল থাকতে সক্ষম এই তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেটের সর্বোচ্চ গতি ৩২ নট বা ৫৯ কিলোমিটার /ঘন্টা, রেঞ্জ ৭,৮১০ কিলোমিটার। ১৮ জন অফিসার সহ ১৮০ জন ক্রু থাকতে পারে একটি তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেটে। 

তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেটে বিভিন্ন ক্যাটেগরির রেডার ব্যবহার করা হয়েছে :—

* এতে প্রধান রেডার হিসাবে রয়েছে রাশিয়ান রোসোবোরনএক্সপোর্টপের তৈরি একটি ৩টিএস-২এসই গ্রাপুন বি সারফেস সার্চ রেডার। এটি আই ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত। এর রেঞ্জ ২৫০ কিলোমিটার। 

* সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি একটি এমআর -২১২/২০১ -১ নেভিগেশন রেডার। শর্ট রেঞ্জ এই রেডারের ন্যাটো নাম প্লাম ফ্রন্ড। এটি এক্স ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত। 

* ব্রিটেনের কেলভিন হুগেস নিউক্লিয়াস ২ ৬০০০ এ রেডার। এটি এক্স ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত। 

* রাশিয়ার তৈরি একটি ফ্রেগ্যাট এম২ইএম থ্রিডি সারকুলার স্ক্যান রেডার। এর ন্যাটো নাম টপপ্লেট, টপ স্টির। এর রেঞ্জ ১৫০ কিলোমিটার। 

* রাশিয়ার তৈরি একটি এম আর ৯০ ওরেখ রেডার যার ন্যাটো নাম ফ্রন্ট ডোম। এটি এক্স ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত এবং এর রেঞ্জ ৩০ কিলোমিটার। 

তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেটে ভারত ইলেকট্রনিক লিমিটেডের তৈরি হামসা সোনার ব্যবহার করা হয়েছে। আবার কোনও রিপোর্ট অনুযায়ী এপিএসওএইচ বা অ্যাডভান্সড প্যানোরোমিক সোনার হাল ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ এব্যাপারে সুস্পষ্ট তথ্য নেই। এছাড়াও একটি রাশিয়ান ব্রোনজা সোনার ব্যবহার করা হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী ফ্রান্সের তৈরি টাওয়েড অ্যারে সোনার এবং রাশিয়ান এসএসএন ১৩৭ ভ্যারিয়েবল ডেফথ সোনারও, যার ন্যাটো নাম স্টির হাইড, ইনস্টল হয়েছে। তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেটে রাশিয়ান টিকে-২৫ই-৫ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সুট ব্যবহার করা হয়েছে। চারটি কেটি-২১৬ ডেকয় লঞ্চার ও ইনস্টল করা হয়েছে। ১২০ টি ১২০ মিলিমিটার চ্যাফ সিস্টেম রয়েছে তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেটে। ট্রেবোভানিয়ে-এম কমব্যাট ব্যাটেল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম রয়েছে তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেটে।

অস্ত্র হিসাবে তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেটে রয়েছে:—-

* অ্যান্টিশিপ মিসাইল হিসাবে রয়েছে রাশিয়ান নোভাটোর ডিজাইন ব্যুরোর তৈরি ৩এম-৫৪ই ক্লাব এন সুপারসনিক অ্যান্টিশিপ মিসাইল যার রেঞ্জ ২২০ কিলোমিটার। 

* ভবিষ্যতে সমস্ত তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেটে ব্রাহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল ইনস্টল করা হবে যার রেঞ্জ ও গতি ক্লাব মিসাইলের থেকে বেশী হবে।

* এয়ারডিফেন্স সিস্টেম হিসাবে ২৪ টি মিডয়াম রেঞ্জ রাশিয়ান শ্টিল -১ স্যাম রয়েছে। তবে ভবিষ্যতে ইসরায়েলের বারাক -৮ ইনস্টল হতে পারে। 

* ক্লোজ রেঞ্জের জন্য একটি ১০০ মিলিমিটার এ-১৯০ই গান রয়েছে।

* দুটি একে -৬৩০ ও দুটি কাস্টান এয়ারডিফেন্স গান টয়েছে।

* অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারের জন্য একটি আরবিইউ -৬০০০ রকেট লন্চার ও দুটি ৫৩৩ মিলিমিটার ডিটিএ-৫৩-১১৩৫৬ টর্পেডো টিউব রয়েছে। 

একটি তলোয়ার ক্লাস ফ্রিগেট একটি হেলিকপ্টার বহন করতে সক্ষম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *