ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রথম শক্তিশালী রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ার। যা ছিল পাকিস্তানের ত্রাসের কারন। জানুন বিস্তারিত যুদ্ধজাহাজটি সম্পর্কে
রাজেশ রায়: ভারতীয় নৌবাহিনীর এখনও সার্ভিসে থাকা সবচেয়ে পুরোনো ডেস্ট্রয়ার হচ্ছে রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ার। যদিও ১৯৪৯ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীতে আর ক্লাস ডেস্ট্রয়ার যুক্ত হয় যা ১৯৭০ সালে অবসরে যায়। তবে রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ারই হচ্ছে ভারতীয় নৌবাহিনীতে যুক্ত হওয়া প্রথম ডেডিকেটেড ডেস্ট্রয়ার। তাই রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ারকেই বলা হয় ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রথম ডেস্ট্রয়ার। ডেস্ট্রয়ার শব্দের অর্থেই বোঝা যাচ্ছে যার প্রধান কাজ হচ্ছে শত্রুর জাহাজ ধ্বংস করা। ডেস্ট্রয়ার তৈরির উদ্দেশ্য থাকে এমন ধরনের যুদ্ধজাহাজ তৈরি করা যা মাঝারি আয়তনের হবে, গতি বেশী হবে সহজেই ম্যানুভারেবল হবে এবং অনেকটা এলাকা জুড়ে, প্রায় ২০০০ কিমি, সুরক্ষা দিতে পারবে। একটি ডেস্ট্রয়ার এয়ার টার্গেট যেমন শত্রুর যুদ্ধবিমান, ড্রোন, মিসাইলের পাশাপাশি যুদ্ধ জাহাজ, সাবমেরিনের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে সক্ষম, তার জন্য ডেস্ট্রয়ারে প্রচুর পরিমানে বিভিন্ন ক্যাটেগরির মিসাইল, গান ও টর্পেডো থাকে। সাধারণত হাইভ্যালু টার্গেট যেমন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের সুরক্ষার জন্য ডেস্ট্রয়ার তৈরি করা হয়। একটি এয়ারক্যাফট ক্যারিয়ারের সাথে তিনটি ডেস্ট্রয়ার, তিনটি ফ্রিগেট, ২-৩ টি সাবমেরিন একটি ফর্মেশন তৈরি করে অ্যাটাকে যায় একে ক্যারিয়ার ব্যাটেলগ্রুপ বলে।তাই ডেস্ট্রয়ার কে যে কোন দেশের নৌবাহিনীর মেরুদন্ড বলা হয়।
রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ার তৈরি হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রজেক্ট ৬১ বা কাশিন ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের উপর বেসড করে। ১৯৬০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নৌবাহিনীতে যুক্ত হয় এই কাশিন ক্লাস ডেস্ট্রয়ার। ১৯৭০ সালে কাশিন ক্লাসের আপগ্রেডেড ভার্সন রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ার তৈরি করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। একে কাশিন ২ ক্লাস ডেস্ট্রয়ার বলা হত, ভারত এর নাম দেয় রাজপুত ক্লাস। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ৬১ কমুনারা শিপবিল্ডিং প্ল্যান্টে এই ডেস্ট্রয়ার গুলো তৈরি হয়। ১৯৯৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর এই শিপবিল্ডিং প্ল্যান্ট ইউক্রেনের ভাগে পড়ে, বর্তমানে এর নতুন নাম হয় মিকোলিয়াভ শিপইয়ার্ড। ভারত মোট পাচটি রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ার কেনে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। প্রথম রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ার আইএনএস রাজপুত যার কোড নেম ডি ৫১ ৪ মে, ১৯৮০ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়, দ্বিতীয় জাহাজ আইএনএস রানা যার কোড নেম ডি ৫২, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮২ সালে, তৃতীয় জাহাজ আইএনএস রনজিত যার কোড নেম ডি ৫৩, ২৪ নভেম্বর, ১৯৮৩ সালে, চতুর্থ জাহাজ আইএনএস রনভীর যার কোড নেম ডি ৫৪, ২১ এপ্রিল, ১৯৮৬ সালে এবং পঞ্চম জাহাজ আইএনএস রনভিজয় যার কোড নেম ডি ৫৫, ২১ ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর ইস্টার্ন কম্যান্ডে এগুলো যুক্ত হয়, যার প্রধান বন্দর বিশাখাপত্তনম। বর্তমানে ভারতীয় নৌবাহিনীতে তিনটি রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ার অ্যাক্টিভ আছে। প্রায় ৪১ বছর সার্ভিসের পর ২১ মে, ২০২১ আইএনএস রাজপুত কে অবসরে পাঠানো হয় এবং ২০১৯ সালের ৬ মে আইএনএস রনজিত কে অবসরে পাঠানো হয় কারন লাইভ এক্সারসাইজ “TROPEX-21” এর সময় টর্পেডোর আঘাতে রনজিত ডুবে যায়।
একটি রাজপুত ক্লাস গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ারের ডিসপ্লেসমেন্ট ৩৯৫০ টন তবে সমস্ত অস্ত্র সহ ডিসপ্লেসমেন্ট ৪,৯৭৪ টন। ১৪৭ মিটার লম্বা ও ১৬ মিটার চওড়া রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের সর্বোচ্চ গতি ৩৫ নট বা ৬৫ কিলোমিটার /ঘন্টা। এতে ইন্জিন হিসাবে রয়েছে ইউক্রেনের ৪ টি জোরিয়া ম্যাশপ্রকেট এম ৩ ই গ্যাস টার্বাইন যা ৭২,০০০ হর্স পাওয়ার বা ৫৪,০০০ কিলোওয়াট শক্তি উৎপন্ন করে। একটি রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের সর্বোচ্চ রেঞ্জ প্রায় ৮৩০০ কিমি। এই শ্রেনির একটি জাহাজে ৩৫ জন নাবিক সহ মোট ৩২০ জন ক্রু থাকতে পারে।
রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে অনেক ক্লাসের রেডার ব্যবহার করা হয়েছে :–
নেভিগেশন:– সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি দুটি ভলগা রেডার ব্যবহার করা হয়েছে যা নেভিগেশন কাম সারফেস সার্চের জন্য ব্যবহার হয়, এটি আই ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত। এর ন্যাটো নাম ডন কে। রাশিয়া পরে এর আপডেটেড ভার্সন তৈরি করে যার নাম প্লাম ফ্রন্ড।
এয়ার:– এয়ার সার্চের জন্য এতে একটি সি ব্যান্ডের এমপি-৫০০ ক্যালিভার রেডাট ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি ডি ব্যান্ডের একটি এলডব্লুউ ০৮ রেডার ব্যবহার করা হয়েছে যার রেঞ্জ ২৭০ কিমি।
এয়ার/সারফেস:— এক্ষেত্রে প্রথমে ব্যবহার করা হয়েছিল সোভিয়েত এমআর ৩১০ ইউ আঙ্গারা রেডার যার ন্যাটো নাম হেড-নেট সি যা ই ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত। যার রেঞ্জ ২০০ কিমি প্রায়। পরে এই রেডারকে রিপ্লেস করা হয় ইসারায়েলের ইএল/এম-২২৩৮ ৩ডি স্টার রেডার দিয়ে। ইসরায়েল এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি এল্টার তৈরি এই রেডার আদতে একটি মাল্টি পারপাস এয়ার এন্ড সারফেস সার্চ নেভাল রেডার, যা মাঝারি আয়তনের যুদ্ধজাহাজ বিশেষ করে ফ্রিগেট ও করভেটের জন্য উপযুক্ত। ভারতের শিবালিক ক্লাস ও গোদাবরী ক্লাস ফ্রিগেটেও এই রেডার ব্যবহার করা হয়েছে। এস ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত এই রেডারের রেঞ্জ ৩৫০ কিমি। ইসরায়েল ছাড়াও ভারত, সিঙ্গাপুর ও বলিভিয়া এই রেডার ব্যবহার করে।
* কমিউনিকেশন সিস্টেমের জন্য ব্রিটিশ স্যাটেলাইট কোম্পানি এমারস্যাটের লিংক ব্যবহার করা হয়েছে।
* রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে প্রথমে সোনার হিসাবে ব্যবহার করা হত এমজি-৩১১ যার ন্যাটো নাম উল্ফ প। পরে একে ভারতের হামসা সোনার ও এমজি-৩২৫ দিয়ে রিপ্লেস করা হয়।
রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয় :–
* ৮ টি ব্রাহ্মস মিসাইল।
* একটি ধনুশ ব্যালিস্টিক মিসাইল। ধনুশ মিসাইল একটি শর্ট রেঞ্জ ব্যালেস্টিক মিসাইল। ডিআরডিও এর ডিজাইন করেছে এবং ভারত ডায়নামিক্স লিমিটেড এটি তৈরি করেছে। পিথবী-৩ ব্যালেস্টিক মিসাইলের একটি ভার্সন এই ধনুশ মিসাইল যাকে ইন্ডিয়ান নেভির জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। এর রেঞ্জ মোটামুটি ৩৫০-৭৫০ কিমি।
* চারটি এসএস-এন-টু মিসাইল, সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি এই মিসাইলের আসল নাম পি-১৫ টারমিট। ১৯৫০ সালে রাডুগা ডিজাইন ব্যুরো এটি তৈরি করে। এর ন্যাটো নাম এসএস-এন-টু বা স্টায়িক্স। এটি একটি সাবসনিক অ্যান্টিশিপ মিসাইল যার রেঞ্জ ৪০-৮০ কিলোমিটার।
* এয়ার ডিফেন্স হিসাবে রয়েছে ২টি এস-১২৫ স্যাম লঞ্চার। ১৯৬১ সালে তৈরি এই এস-১২৫ নেভা/পিচোরার ন্যাটো নাম এসএ-৩ গোয়া। তবে এর নেভাল ভার্সন এর নাম এসএ-এন-১ গোয়া। এছাড়াও এয়ারডিফেন্স সিস্টেম হিসাবে রয়েছে ইসরায়েলের বারাক ১ মিসাইল। রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে এমন আটটি বারাক -১ মিসাইল লঞ্চ শেল রয়েছে।
* ক্লোজ রেঞ্জের জন্য রয়েছে ৭৬.২ মিলিমিটার মেইন গান, ৩০ মিলিমিটার একে-২৩০, একে-৬৩০ এম গান।
* অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারের জন্য রয়েছে ১ টি ৫৩৩ মিলিমিটার টরপেডো টিউব ও ২ টি আরবিইউ ৬০০০ অ্যান্টি সাবমেরিন রকেট লঞ্চার।
* রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ার একটি কামোভ -২৮ হেলিকপ্টার বহন করতে পারে।