ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ যেভাবে ইরানের পরমানু কেন্দ্রে হামলা করার ছক কষেছিল
নিজস্ব সংবাদদাতা:ইরানের ভূগর্ভস্থ পরমাণু কেন্দ্র ধ্বংসের পেছনে ইসরায়েলি যোগের কথা বহুদিন আগেই আন্দাজ করা হয়েছিল। কিন্তু, সেই সময় মুখ খোলেনি ইসরায়েল। অবশেষে মৌনতা ভঙ্গ করে ইরানে অপারেশন পরিচালনার বিস্তারিত তথ্য সাক্ষাৎকারে তুলে ধরলেন ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদ্য বিদায়ী প্রধান আধিকারিক নেয়া ইয়োসি কোহেন। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ইরানে গোটা অপারেশন কিভাবে সম্পন্ন করা হয়েছিলো তার রোমহর্ষক বর্ণনার সাথে সাথে ইরানের পরমাণু আর্কাইভ থেকে কিভাবে সমস্ত নথিপত্র চুরি করা হয়েছিলো সেই সমস্ত তথ্যই ফুটে উঠেছে ইয়োসি কোহেনের দেওয়া সাক্ষাৎকারে। প্রসঙ্গত,ইসরায়েলের হয়ে দা বিভাগ এক গোপন অভিযান চালিয়ে ২০১৮ সালে ইরানের পরমাণু গবেষণা সংক্রান্ত হাজার হাজার নথিপত্র চুরি করেছিলো। এতদিন এই নিয়ে নানা গুঞ্জন চললেও ইসরায়েলি কোনো আধিকারিক কখনো ইরান থেকে নথি চুরির কথা সরাসরি স্বীকার করেনি। তবে, এবার সরাসরি স্বীকার না করলেও ইরানের পরমাণু কেন্দ্র নাতাঞ্জে ধ্বংস যজ্ঞ এর সাথে সাথে সেখানকার পরমাণু বিজ্ঞানীর হত্যার পেছনেও যে ইসরায়েলি যোগ রয়েছে সেকথা চ্যানেল ১২-এর সাংবাদিক ইলানা ডায়ানকে দেওয়া কোহেনের সাক্ষাৎকারেই পরিষ্কার হয়ে গেছে।
সংবাদমাধ্যমের সামনে উচ্চ পর্যায়ের কোনো গোপন অভিযান নিয়ে মুখ খোলা বা সাক্ষাৎকার দেওয়া মোসাদের সদ্য বিদায়ী প্রধানের কাছে নতুন কোনো ব্যাপার না হলেও এবারের সাক্ষাৎকারে তার বলা বেশ কিছু কথা অবাক হতে বাধ্য করেছে বিবিসির নিউজ অনলাইনের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সম্পাদক রাফি বের্গকেও। সব চেয়ে বড় কথা অনেক হিসাব নিকেশ করে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সেন্সর পেরিয়েই দিনের আলো দেখেছে সাক্ষাৎকারটি। আর সেই সাক্ষাৎকারেই প্রথমবারের মত কোহেন ইরানের ভূগর্ভস্থ পরমাণু কেন্দ্র ধ্বংসের সঙ্গে ইসরায়েলি যোগের ইঙ্গিত দেওয়ায় অনেকেই সন্দেহ করছে এর পেছনে কাজ করছে ইসরায়েল সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা।
১৯৮২ সালে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে পড়াশোনা শেষ করে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থায় যোগ দিয়েছিলেন ইয়োসি কোহেন।দীর্ঘ বহু বছর সেখানে কাজ করার পর অবশেষে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ২০১৫ সালে মোসাদের প্রধান হিসাবে নিয়োগ করেন তাকে। কোহেনের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে তার কর্মিজীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোচনা শুরু হলে জানা যায় এই পেশায় থাকাকালীন আত্মগোপনীয়তার স্বার্থে সেই সময় তার কাছে সব সময় থাকতো অসংখ্য পাসপোর্ট।
কোহেনের সাথে ইলানা ডায়ানের সাক্ষাৎকার প্রথমে আর পাঁচটা সাধারণ ইন্টারভিউয়ের মত করেই শুরু হলেও ইরান সম্পর্কিত আলোচনা শুরু হতেই পরমাণু আর্কাইভ থেকে তথ্য চুরি সম্পর্কিত নানা অজানা বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেন তিনি। প্রসঙ্গত এর আগে ২০১৮ সালেও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এক সাংবাদিক সম্মেলনে ইরানের চুরি যাওয়া নথি সম্পর্কে উল্লেখ করে জানিয়েছিলেন ইরান গোপনে পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। এমনকি সেই অস্ত্র তৈরির প্রযুক্তিও যে ইরানের আছে সে কথা সাংবাদিক সম্মেলনেই খোলসা করে বলেছিলেন তিনি। ইরান স্বাভাবিক ভাবেই সেই সময় যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছিল। তবে, কোহেনের মিডিয়াকে দেওয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারের পর স্বাভাবিক ভাবেই পুনরায় সন্দেহ গিয়ে পড়ছে ইরানের ওপর।
মি. কোহেন এর দেওয়া স্বাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে নানা অজানা তথ্য। জানা যায় ইরানে অপারেশন চালানোর জন্য প্রস্তুতি চলেছিল প্রায় দু বছর ধরে। এছাড়াও জানা গেছে তেল আভিভের একটি কমান্ড সেন্টার থেকে নজরদারি করা ওই অপারেশনে অংশ নেওয়া ২০ জন এজেন্টের মধ্যে একজনও ছিলেন না ইসরায়েলি নাগরিক। জানা যাচ্ছে, এজেন্টরা ওয়্যারহাউজের ভেতরে প্রবেশ করে ৩০টির বেশি সিন্দুক ভাঙ্গে। ইসরায়েলি পত্রিকা দি টাইমস অফ ইসরায়েল কে দেওয়া সাক্ষাৎকার কোহেন বলেছেন ইরানের পরমাণু কেন্দ্রের ওয়্যারহাউজে ঢুকে সিন্দুক ভেঙে শেষ পর্যন্ত যখন তার মধ্যে থাকা নথিপত্রের ছবি তুলে এজেন্টরা পাঠায়, সেই মুহূর্তটা তাদের প্রত্যেকের কাছে অত্যন্ত স্মরণীয়।
এই প্রথম গোটা অপারেশন নিয়ে খোলাখুলি সংবাদমাধ্যমে কথা উঠলেই এর আগেও প্রকাশ্যে ইসরায়েল বেশ কয়েকবার প্রকাশ্যে ইরান থেকে উদ্ধার করা এই নথিপত্রগুলি সম্পর্কে কথা তুলেছিলো। তবে, এবার মি. কোহেনের দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাথে ইরানের নথি চুরির যোগ থাকা যেমন প্রমাণ হয়েছে তেমনই সামনে এসেছে এরকমই গোপন আরো বেশ কিছু অপারেশনের কথা ।
২০২০ সালের জুলাই মাসে নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ অংশে আগুন লেগেছিলো প্রথমবার। তারপর সেই বছরের এপ্রিলে পরমাণু কেন্দ্রটিকে নতুন রূপে পুনরায় সাজিয়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু তার কয়েকদিনের মধ্যেই আবার সেখানে ঘটে নাশকতা, বড় ধরেনের ক্ষয় ক্ষতি হয়।এই ঘটনায় প্রথম থেকেই ইসরায়েলের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে এসেছে ইরান। সেই সময় দাবি করা হয় ইসরায়েলেই “পরমাণু সন্ত্রাস” চালিয়েছে ইরানে। মিস ডায়ানকে দেয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে মি. কোহেন ইরানের দাবিকেই এক প্রকার ভাবে মেনে নিয়ে জানান ওই পরমাণু স্থাপনা কেন্দ্রটিকে তিনি এতটাই ভালো ভাবে চিনে গেছেন যে কেউ সেখানকার ঘূর্ণায়মান সেন্ট্রিফিউজ অব্দি তাকে পৌঁছে দিতে বললে অনায়াসেই পথ চিনে জায়গা মত পৌঁছে দিতে পারবেন তিনি।
সাক্ষাৎকারে ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মহসেন ফাখরিজাদকে মৃত্যু নিয়ে ওঠে কথা। প্রসঙ্গত, গুপ্তঘাতকের হামলায় গত বছর নভেম্বরে তেহরানের উপকণ্ঠে একটি সড়কে নিহত হন তিনি। প্রথম থেকেই ইরান ওই হামলায় জন্য প্রকাশ্যে ইসরায়েল কে দায়ী করে আসছে। এবারের সাক্ষাৎকারে প্রাক্তন মোসাদ প্রধান সেই হামলার দায় সরাসরি স্বীকার বা অস্বীকার না করলেও জানান উক্ত ওই বিজ্ঞানী মোসাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠায় দীর্ঘদিন ধরেই ‘টার্গেট’ এ ছিলেন তিনি। এ প্রসঙ্গে কোহেন জানান ” ইসরায়েল ও ইসরায়েলের নাগরিকদের জন্য কোনো ব্যক্তি যদি বিপদজনক হয়ে ওঠে তাহলে তাকে অবশ্যই থামানো হবে। তবে, হ্যাঁ। যদি কেউ ইসরায়েলের ক্ষতি সাধনের মত আর কোনো কাজ না করে বা পেশা পরিবর্তন করে তবে তিনি বেঁচেও যেতে পারেন।” ইরানের পরমাণু চুক্তির পুনর্জীবন নিয়ে আলোচনা সভা শুরু হতে চলেছে শীগ্রই এরই মধ্যে মোসাদ প্রধানের এই সাক্ষাৎকার আলোড়ন ফেলেছে চারিদিকে।