অফবিট

পাবজি, টেসলাতে বিপুল বিনিয়োগ। চীনের গোপন সংস্থা যেভাবে চীনের সম্পূর্ন জনজীবনকে নিয়ন্ত্রন করছে

বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও কবি জর্জ অরওয়েল তার উপন্যাস ১৯৮৪তে এমন একটি সমাজের কথা লিখেছিলেন যেখানে সরকার আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে চব্বিশ ঘন্টা দেশের নাগরিকদের উপর নজর রাখে। জর্জ অরওয়েলের উপন্যাসের মতোই বর্তমানে চীন তার একটি সংস্থার মাধ্যমেই এই ঘটনা সত্যি করে দেখিয়েছে। বিশ্বের প্রথম সারির সংস্থাগুলোর কথা বললে প্রথমেই মাথায় আসে অ্যাপেল, গুগল, মাইক্রোসফট ও মেটার মতোন সংস্থার নাম। ঠিক একইভাবে বিশ্বের ধনী ব্যবসায়ীদের কথা বলতে গেলে এলন মাস্ক, মার্ক জুকারবার্গ, বিল গেটসের কথাই সবচেয়ে প্রথমে বলতে হয়। কিন্তু চীনের এমন একটি বিখ্যাত সংস্থা আছে যার ব্যাপারে তেমন কোনও তথ্যই জানা যায়না। চীনের এই সংস্থাটির নাম টেনসেন্ট, বিশ্ববাজারে সংস্থাটির মূল্য ৪৪০ বিলিয়ন ডলার। মিডিয়া ব্র্যান্ডের এর দিক দিয়ে টেনসেন্ট এর অবস্থান বিশ্বে সপ্তম কিন্তু তাসত্ত্বেও টেনসেন্টের ব্যাপারে ইন্টারনেটে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়। টেনসেন্ট বিশ্বের সবচেয়ে বড় গেমিং সংস্থা, পাবজির মতোন বিখ্যাত গেমের সহকারী নির্মাতা এই টেনসেন্টই। এর পাশাপাশি রেডিট, স্ন্যাপচ্যাট, স্পটিফাই, টেসলা ও টিকটকের মতো সংস্থায় সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী সংস্থাও এই টেনসেন্ট। কিন্ত এত বড় সংস্থা হওয়া সত্বেও টেনসেন্টের ব্যাপারে এত কম তথ্য পাওয়া যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই সংস্থাটিকে ঘিরে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। 

১৯৯৮ সালে এক চাইনিজ ব্যবসায়ী ও কোডার পোনি মা টেনসেন্ট নামক সংস্থাটি তৈরি করেন। ১৯৯৯ সালে টেনসেন্ট ওআইসিকিউ নামে একটি চ্যাট সার্ভিস তৈরি করে। চীনে এই চ্যাট সার্ভিস দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে তবে এই চ্যাট সার্ভিস ঘিরে বিতর্কও তৈরি হয়, অভিযোগ ওঠে পোনি মা ওআইসিকিউ নকল করেছে একটি বিদেশি সংস্থা থেকে। ১৯৯৬ সালে ইসরায়েলের একটি সংস্থা আইসিকিউ নামে একটি মেসেজ সার্ভিস তৈরি করেছিল। এই মেসেজ সার্ভিসকেই নকল করে পোনি মা এবং পেঙ্গুইনের লোগো লাগিয়ে চীনে ওআইসিকিউ নামে প্রকাশ করেছিল। শুধু পোনি মাই নয় সেসময় চীনে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রযুক্তি নকল করে বহু সংস্থাই তৈরি হয়েছিল যেমন জ্যাক মার আলিবাবা ডটকম ইবেএর নকল। চীনে ওআইসিকিউ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলেও আইনের মারপ্যাচে ফেঁসে গিয়ে পোনি মা বাধ্য হয় ওআইসিকিউ নাম বদলে কিউকিউ রাখতে। কিন্তু নাম বদলানোর পরেও কিউকিউের জনপ্রিয়তা কমেনি, মাত্র তিন বছরে কিউকিউ এর ব্যবহারীর সংখ্যা পঞ্চাশ মিলিয়নে পৌঁছে যায়। ২০০৪ সালে মাইক্রোসফট এমএসএন নামে একটি ইন্টারনেট মেসেজ সার্ভিস চালু করে। চীনেও এই এমএসএন জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু টেনসেন্ট আবারও তাদের পুরোনো স্বভাব অনুযায়ী মাইক্রোসফটের আইডিয়া নকল করে কিউকিউকে আপগ্রেড করা শুরু করে। যার জন্য কিউকিউ এমএসএনের থেকেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মাইক্রোসফটের মতোন বড় প্রযুক্তি সংস্থার টেনসেন্টের সামনে পিছিয়ে পড়ার ঘটনায় চীনে টেনসেন্টের জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায়। চ্যাট সার্ভিসের পর টেনসেন্ট গেমিং সেক্টরে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়। এর জন্য টেনসেন্ট অনেক বিদেশি গেমিং সংস্থাকে কিনে নেয়। এক্ষেত্রে চীনের নীতি টেনসেন্টকে সহায়তা করে। 

চীনের নীতি অনুযায়ী কোনও বিদেশি সংস্থা চীনে বিনিয়োগ করতে এলে প্রথমে তাকে চীনের স্থানীয় কোনও সংস্থার সাথে সহযোগী হতে হবে। এই সময় পশ্চিমা অনেক গেমিং সংস্থাই টেনসেন্টের সাথে চুক্তি করে। একটা সময় টেনসেন্ট এসব সংস্থার অধিকাংশই কিনে নেয় এবং তাদের জনপ্রিয় গেমের চাইনিজ ভার্সন তৈরি করে চীনে বিনামূল্যে প্রকাশ করে। এর ফলে টেনসেন্টের গেমিং ব্যবহারকারীর সংখ্যা ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পায়। এভাবে টেনসেন্ট বিশ্বের সবচেয়ে বড় গেমিং সংস্থায় পরিনত হয়। তবে শুধুমাত্র গেমিং এর জন্যই টেনসেন্ট চীনের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংস্থায় পরিনত হয়নি বরং উইচ্যাট নামক একটি অ্যাপের কারন আজ টেনসেন্ট সমগ্র চীনের জনজীবনকে নিয়ন্ত্রন করছে।

২০১০ সালে গোটা বিশ্ব কম্পিউটার থেকে ধীরে ধীরে মোবাইলের দিকে সরে যেতে শুরু করে। এই সময় টেনসেন্ট উইচ্যাট নামে একটি অ্যাপ তৈরি করে। প্রথম দিকে এই অ্যাপ অনেকটা হোয়াটসঅ্যাপের মতোই ছিল। কিন্তু কিছু সময় পর টেনসেন্ট এই অ্যাপে ভয়েস টু টেক্সট প্রযুক্তি যোগ করে যারপর এই অ্যাপ চীনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে। তবে এই আইডিয়াও অ্যাপেলের টক বক্স থেকে নকল করেছিলো টেনসেন্ট। তবে পোনি মা বুঝে গিয়েছিল স্মার্টফোনই ভবিষ্যৎ। সেজন্য উইচ্যাটে ব্যাপক প্রযুক্তি যোগ করে টেনসেন্ট। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, পেপল, নেটফ্লিক্স, উবের সহ একাধিক বিখ্যাত অ্যাপের মতোই সবসুযোগ সুবিধা উইচ্যাটে যুক্ত করেছে টেনসেন্ট। যার জন্য চীনে উইচ্যাটের জনপ্রিয়তা শীর্ষে রয়েছে। চীনে উইচ্যাট এতটাই জনপ্রিয় যে দেশটির ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ১.৩ বিলিয়ন লোকই উইচ্যাট ব্যবহার করে। টেনসেন্টকে বিশ্বব্যাপী বহু মানুষ না চিনলেও চীনে টেনসেন্টকে চেনেনা এমন মানুষ খুব কমই আছে। এভাবে একটি মেসেজ সার্ভিস সংস্থা থেকে টেনসেন্ট ধীরে ধীরে চীনের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রন করছে। আমেরিকার সমস্ত জনগন যেখানে প্রতিদিন গড়ে দুই ঘন্টা সমস্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিবাহিত করে সেখানে চীনে প্রায় সমস্ত জনগনই প্রতিদিন গড়ে চার ঘন্টা করে উইচ্যাট ব্যবহার করে। বলা হয় চীনে টেনসেন্টের এত জনপ্রিয়তা ও সাফল্যের পেছনে দেশটির সরকারের যথেষ্ট বড় ভূমিকা রয়েছে। উইচ্যাটে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে যেখানে সরকার বিরোধী বা সরকারের সমালোচনা করা কোনও মেসেজ, ভিডিও পাঠানোই যাবেনা। উইচ্যাটের মাধ্যমে সমস্ত চাইনিজ জনসংখ্যার ডাটা রয়েছে চীনের সরকারের কাছে। অর্থাৎ জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস ১৯৮৪ এর মতোনই চীন তার প্রত্যেক নাগরিকের উপর নিয়ন্ত্রন রেখেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *