অফবিট

রাশিয়া ও অস্ট্রিয়াকে যুদ্ধে পরাজিত করতে কি রণনীতি নিয়েছিলেন নেপোলিয়ন?

আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা সামরিক জেনারেল বলা হয় ফ্রান্সের শাসক নেপোলিয়ন বোনাপার্টকে। বিশ্বের প্রায় সমস্ত সামরিক শিক্ষালয়ে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের অসাধারন রননীতির কথা পড়ানো হয়। ছোট সেনাবাহিনী নিয়েও শুধুমাত্র অসাধারন সামরিক নীতির মাধ্যমে যেভাবে তিনি ইউরোপের শক্তিশালী সাম্রাজ্যদের যুদ্ধে পরাজিত করে ফ্রান্স সাম্রাজ্যের সীমা বৃদ্ধি করেছিলেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ১৮০৩ সাল থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের শাসক নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বিরুদ্ধে ব্রিটেন, রোমান সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া, প্রুশিয়া, রাশিয়া, স্পেন, সুইডেন, পর্তুগাল, অটোমান সাম্রাজ্য, ডাচ, হাঙ্গেরি সহ গোটা ইউরোপের বিভিন্ন সাম্রাজ্য সংঘবদ্ধ হয়ে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ করে যাকে নেপোলিয়নিক যুদ্ধ বলা হয়, যা প্রমান করে সেসময় ইউরোপে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের কতটা প্রভাব ছিল। এমনই একটি নেপোলিয়নিক যুদ্ধ হল অস্টারলিটজের যুদ্ধ যাকে তিনটি সম্রাটের মধ্যে যুদ্ধও বলা হয়। রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নেপোলিয়নের যুদ্ধ হয়েছিল অস্টারলিটজ শহরের কাছে যাতে তুলনামূলক কম সংখ্যক সেনাবাহিনী থাকা সত্বেও বিজয়ী হয় নেপোলিয়নের ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনী।

১৭৯২ সালে ফরাসী বিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে ইউরোপ অশান্ত হয়ে ওঠে। পাঁচ বছর পর ১৭৯৭ সালে অস্ট্রিয়া, প্রুশিয়া, গ্রেট ব্রিটেন, স্পেন এবং বিভিন্ন ইতালিয়ান রাজ্য যৌথভাবে প্রথম সম্মিলিত জোট গঠন করে যাতে ফ্রান্সের অস্থির রাজনৈতিক সংকটের সুযোগে ফ্রান্সের বিভিন্ন এলাকা দখলের করা যায়। কিন্তু ফ্রান্সের সেনাবাহিনী এই প্রথম সম্মিলিত জোটকে পরাজিত করে। ১৭৯৮ সালে ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, অটোমান সাম্রাজ্য, পর্তুগাল এবং নেপলস দ্বিতীয় সম্মিলিত জোট গঠন করে। 

১৭৯৯ সালের ২৩ আগস্ট নেপোলিয়ন অসফল মিশর অভিযান থেকে ফিরে আসে এবং ৯ নভেম্বর ফ্রান্সের ক্ষমতা দখল করে। ১৮০১ সালে দ্বিতীয় সম্মিলিত জোটকেও পরাজিত করে ফ্রান্স। এরপর ব্রিটেন বাধ্য হয় ফ্রান্সের সাথে ১৮০২ সালের মার্চ মাসে অ্যামিয়েনস শান্তি চুক্তি করতে। নেপোলিয়ন ফ্রান্সের সম্রাট হয়েই সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ইতালির বিভিন্ন প্রান্তে আক্রমন করে, সাথে সাথে ব্রিটেনের উপনিবেশ গুলোর জন্য হুমকী হয়ে দাঁড়ায় নেপোলিয়ন। নেপোলিয়ন এইসময় সরাসরি ঘোষনা করে ইউরোপের রাজনীতি থেকে ব্রিটিশদের সরে দাঁড়ানো উচিৎ যা ব্রিটিশদের ক্ষুব্ধ করে। অ্যামিয়েনসের চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেনের মাল্টা থেকে তার সেনাবাহিনী সরিয়ে ফেলার কথা ছিল কিন্তু ব্রিটেন মাল্টা থেকে তার সেনাবাহিনী সরায়নি যা ক্ষুব্ধ করে নেপোলিয়নকে। যার ফলস্বরূপ ব্রিটিশ উপনিবেশ হাইতিতে বিদ্রোহ দমন করতে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দেয় নেপোলিয়ন। এরপরই ব্রিটেন অ্যামিয়েনসের চুক্তি বাতিল করে ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ ঘোষনা করে ১৮০৩ সালের মে মাসে। 

নেপোলিয়নের সমস্ত যুদ্ধের সূচনা এই যুদ্ধ থেকেই শুরু হয়। ১৮০৪ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটেন ও সুইডেন যৌথভাবে তৃতীয় সম্মিলিত জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জোট গঠনের জন্য অনেক দেশের সাথে কুটনৈতিক বৈঠক করে। অবশেষে ১৮০৫ সালের এপ্রিলে ব্রিটেন ও রাশিয়া সম্মিলিত জোট গঠন করে, কয়েক মাস পর অস্ট্রিয়া ও সুইডেন এই জোটে যোগদান করে। তবে ব্রিটেনের তৃতীয় সম্মিলিত জোট গঠনের আগেই নেপোলিয়ন ইংল্যান্ড আক্রমনের জন্য একটি বিশাল সেনা গঠন করা শুরু করে। এই সেনাবাহিনীর নাম ছিল আর্মি ডি অ্যাঙ্গলেটারে বা ইংল্যান্ডের সেনাবাহিনী। উত্তর ফ্রান্সের বুলোনজে এই সেনবাহিনীকে রীতিমতো প্রশিক্ষন করা শুরু হয় এবং তাদের সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য প্রশিক্ষন দেওয়া হয়। এই সেনাবাহিনীতে প্রায় দেড় লাখ সেনা ছিল। নেপোলিয়ন ইংল্যান্ড বিজয়ের জন্য নিশ্চিত ছিল কিন্তু সমস্যা হল ইংল্যান্ডের সাথে ইউরোপের মূল ভূখন্ডের কোন সংযোগ ছিলনা কারন ইংল্যান্ড ইউরোপের মূল ভূখন্ড থেকে ইংলিশ চ্যানেল দ্বারা আলাদা একটি দেশ ছিল। যার কারনে সরাসরি স্থলসেনা নিয়ে ইংল্যান্ডে আক্রমন করা সম্ভব ছিলনা।  ইংল্যান্ডে আক্রমন করতে হলে নৌবাহিনী ব্যবহার করতে হত। কিন্তু ব্রিটিশ নৌবাহিনীর মতো শক্তিশালী সেসময় কোনও নৌবাহিনী ছিলনা। যার কারনে ইংল্যান্ড আক্রমনের জন্য নেপোলিয়ন একটি পরিকল্পনা তৈরি করে। নেপোলিয়ন ঠিক করে ওয়েস্ট ইন্ডিজে ব্রিটিশ উপনিবেশের উপর হামলা করবে যাতে ব্রিটেনের মনোযোগ ওইদিকে চলে যায় এবং এই সুযোগে ব্রিটেন আক্রমন করা হবে। কিন্তু ১৮০৫ সালে ট্রাফালগারের যুদ্ধে ব্রিটিশ নৌবাহিনী ফ্রান্সের নৌবাহিনীকে পরজিত করে, এরপর নেপোলিয়ন আর ইংল্যান্ড আক্রমন করেনি। নেপোলিয়ন এরপর ইউরোপ দখলের জন্য তার সেনাবাহিনীর বহর আরও বাড়াতে শুরু করে, এই সেনাবাহিনীর নাম দেওয়া হয় লা গ্রান্ডে আর্মি। 

১৮০৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে নেপোলিয়নের গ্রান্ড আর্মিতে সেনা সংখ্যা দাঁড়ায়  ৩,৫০,০০০. এছাড়াও ২২,০০০ সদস্য বিশিষ্ট বিশাল অশ্বারোহী সেনাও ছিল এই সেনাবাহিনীতে। এই পুরো সেনাবাহিনীকে সাতটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল, প্রতিটি বিভাগের কাছে ৩৬- ৪০ টি কামান ছিল। প্রতিটি সেনাকে পর্যাপ্ত সামরিক প্রশিক্ষন দেওয়া হয়েছিল যাতে যুদ্ধক্ষেত্রে কোনও সাহায্য না পেলেও একজন সেনা একদিন বেঁচে থাকতে পারে। অস্ট্রিয়ান সম্রাটের ভাই আর্চডিউক চার্লস ১৮০১ সাল থেকেই অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন শুরু করে। অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে দক্ষ কম্যান্ডার ছিল এই আর্চডিউক চার্লস। 

১৮০৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ৭০,০০০ সেনা সহ বাভেরিয়া আক্রমন করার মাধ্যমে অস্ট্রিয়া ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক ভাবে যুদ্ধের সূচনা করে। বাভেরিয়া সেসময় ফ্রান্সের বন্ধু ছিল তাই বাভেরিয়া আক্রমন করে অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনী। এই আক্রমন রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার একসাথে করার কথা ছিল কিন্তু অস্ট্রিয়া সেসময় গ্রিগোরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতো এবং রাশিয়া জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতো। এই দুই ক্যালেন্ডারে তেরো দিনের অন্তর ছিল যার কারনে সঠিক তারিখে সমস্যা হয়ে যায় এবং রাশিয়ান সেনাবাহিনী তখনও নির্দিষ্ট স্থানে এসে পৌঁছাতে পারেনি। নেপোলিয়ন আগে থেকেই জানতো বাভেরিয়া আক্রমন করা হবে যার কারনে তার সেনাবাহিনীও প্রস্তত ছিল। ১৬ অক্টোবর নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীকে ঘিরে ফেলে এবং যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯ অক্টোবরের মধ্যে প্রায় চার হাজার অস্ট্রিয়ান সেনার মৃত্যু হয় এবং ৪৭,০০০ হাজার অস্ট্রিয়ান সেনা আত্মসমর্পন করে নেপোলিয়নের সামনে। বাকী অস্ট্রিয়ান সেনারা পিছনে পালিয়ে যায়। নেপোলিয়ন ভিয়েনা পর্যন্ত দখল করে নেয়। রাশিয়ান সেনাবাহিনী ও পালিয়ে যাওয়া অস্ট্রিয়ান সেনা আবারও একত্রিত হয়ে পেছনে অপেক্ষা করতে থাকে নেপোলিয়নের আসার কিন্তু নেপোলিয়ন এখানে একটা মনস্তাত্ত্বিক খেলা খেলে। নেপোলিয়ন এমন ভাব দেখায় যে ভিয়েনা দখল করতে গিয়ে তার সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে গেছে এবং সে শান্তি চায়। নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়ার রাজা এবং রাশিয়ার জারের কাছে শান্তি প্রস্তাবও পাঠায়। এমনকী ২৫ নভেম্বর নেপোলিয়নের প্রতিনিধি দেখাও করে জারের সাথে। নেপোলিয়ন চাইছিলো শত্রু যাতে বিশ্বাস করে সে দুর্বল এবং তাকে আক্রমন করতে আসে। ঠিক সেটাই হয়, সম্মিলিত জোটের পক্ষ থেকে রাশিয়াকে চাপ দেওয়া হয় নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান করার কারন সম্মিলিত জোট বুঝে যায় নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী দুর্বল এবং এটাই আক্রমনের উপযুক্ত সময়। 

বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের অস্টারলিটজ শহরের কাছে উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে নেপোলিয়নের পক্ষে প্রায় ৭২,০০০ সেনা এবং ১৫৭ বন্দুক ছিল, বিপরীতে সম্মিলিত জোটের পক্ষে ৮৫,০০০ সেনা এবং ৩১৮ বন্দুক ছিল। সম্মিলিত জোটের সত্তর শতাংশ সেনাই রাশিয়ান ছিল। সম্মিলিত জোটের লক্ষ্য ছিল ভিয়েনা যাওয়া সমস্ত রাস্তাকে দখল করা। এই অঞ্চলে যুদ্ধে বিজয়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন জায়গা ছিল প্রাটজেন উপত্যকা যা সম্মিলিত জোটের দখলে ছিল। নেপোলিয়ন জানতো প্রাটজেন উপত্যকা থেকে সম্মিলিত জোটকে না সরালে তার যুদ্ধে জেতা অসম্ভব হয়ে পড়বে। সেই কারনে নেপোলিয়ন এখানে আবারও তার তুখোড় সামরিক নীতি ব্যবহার করে। নেপোলিয়ন ইচ্ছে করে তার সেনাবাহিনীর দক্ষিন ভাগে সেনাসংখ্যা কমিয়ে রাখে যাতে সম্মিলিত জোট এই দুর্বল অংশ দেখে আক্রমনের জন্য প্রাটজেন উপত্যকা ছেড়ে এগিয়ে আসে। 

নেপোলিয়ন ভিয়েনা শহরে তার আরও সাত হাজার সেনা মোতায়েন রেখেছিল দক্ষিন অংশের সেনাবাহিনীতে পরে যুক্ত হওয়ার জন্য। তবে নেপোলিয়ন প্রথমে নিজেও যুদ্ধে বিজয়ের জন্য নিশ্চিত ছিলনা যার কারনে ফ্রান্সে তার স্ত্রী জোসেফাইনকে যুদ্ধের ব্যাপারে কিছু জানায়নি। ২ ডিসেম্বর সকাল আটটার সময় যুদ্ধ শুরু হয়। নেপোলিয়ন যা চেয়েছিল তাই হয় তার সেনার দক্ষিন অংশের দিকে আক্রমন করে সম্মিলিত সেনার সিংহভাগ অংশ, তবে কিছু সংখ্যক সম্মিলিত সেনা তখনও প্রাটজেন উপত্যকাতে ছিল। নেপোলিয়ন তার সেনাকে নির্দেশ দেয় প্রাটজেন ঘাঁটির দিকে রওনা হতে। এইসময় ঘন কুয়াশাও নেপোলিয়নের সেনাকে আত্মগোপনে সহায়তা করে কারন প্রাটজেন ঘাঁটির সেনারা কুয়াশার কারনে নেপোলিয়নের সেনাদের দূর থেকে আসতে দেখতে পায়নি। কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রাটজেন উপত্যকা নেপোলিয়ন দখল করে ফেলে, সম্মিলিত সেনা তেমন কোনও বাধাই দিতে পারেনি। অন্যদিকে দক্ষিন অংশেও নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয় সম্মিলিত সেনা। অস্টারলিটজের যুদ্ধে সম্মিলিত জোটের প্রায় ষোলো হাজার সেনা মারা যায় ও কুড়ি হাজার সেনা আত্মসমর্পন করে। অন্যদিকে নেপোলিয়নের তেরোশো সেনা মারা যায়। এই যুদ্ধে পরাজয়ের সাথে সাথে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে হওয়া তৃতীয় সম্মিলিত জোটও ভেঙে যায়। যুদ্ধ শেষে অস্ট্রিয়া বাধ্য হয় ফ্রান্সের সাথে প্রেসবার্গের চুক্তি করতে যাতে অস্ট্রিয়া তার অনেক জায়গা ফ্রান্সকে দিয়ে দিতে বাধ্য হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *