অফবিট

ব্যাপক দুরাবস্থা, তবে কী পাকিস্তানের মতোই ভেঙে পড়ছে তুরস্কের অর্থনীতি!

তুরস্কের অর্থনীতি ক্রমশ ভেঙ্গে পড়ছে। অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে দুই তৃতীয়াংশ নাগরিক খাদ্য ও জলের জন্য অর্থ পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গিয়েছে ৬৯.৮ শতাংশ। কোনও দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে দেশটির মুদ্রার মানও কমতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এরকম পরিস্থিতিতে দেশটির জনগন সমস্যায় পড়ে কারন দ্রব্যমূল্যের তুলনায় মাইনে অনেকটাই কম বৃদ্ধি হয়। যার জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেও সমস্যায় পড়ে আপামর সাধারন জনগন। ঠিক এটাই হয়েছে বর্তমানে তুরস্কের নাগরিকদের সাথে। 

তুরস্কের মুদ্রার নাম লিরা। ২০১৩ সাল থেকে তুরস্কের অর্থনীতির পতন শুরু হলেও গত বারোমাসে তুরস্কের মুদ্রার ব্যাপক পতন হয়েছে। সেপ্টেম্বর, ২০২১ সালে এক আমেরিকান ডলারের বিপরীতে ৮ লিরা পাওয়া যেত। ডিসেম্বর, ২০২২ আসতে আসতে ১ আমেরিকার ডলার ১৯ লিরার সমতুল্য হয়ে যায়। গত ১১ জুন সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ১ আমেরিকান ডলারের বিপরীতে লিরার মান কমে দাঁড়িয়েছে ৩২.৩৫ লিরা। তুরস্কের স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে তুরস্কে, বর্তমানে দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি হার ৮৫.৫ শতাংশ। খাদ্য ও শক্তির ক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৬ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতি অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ার কারনে তুরস্ককে আন্তর্জাতিক বাজারে কোনও জিনিস কিনতে অতিরিক্ত ডলার খরচ করতে হচ্ছে, এর কারনে তুরস্কের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় কমে যাচ্ছে ক্রমশ। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশটির অর্থনীতি ও ব্যবসার উপর। অতিরিক্ত দামে জিনিস কেনার ফলে ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন খরচ ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে তুরস্কে যার জন্য বেকারত্বও ক্রমশ বাড়ছে। তুরস্কের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে দেশটিতে ব্রেনড্রেন শুরু হয়ে গেছে অর্থাৎ উচ্চশিক্ষিত, প্রশিক্ষিত মানুষরা অন্যদেশে চলে যাচ্ছে কাজের জন্য। এই ঘটনার প্রভাব তুরস্কের অর্থনীতির উপরে পড়েছে। তুরস্কের অর্থনীতি পতনের অন্যতম বড় কারন তুরস্ক সরকারের সুদের হার কমিয়ে দেওয়া। একটা সময় তুরস্কের অর্থনীতি যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। অর্থনীতির অলিখিত নিয়ম হচ্ছে শক্তিশালী অর্থনীতি গঠনের জন্য, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রন ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কমানোর জন্য সুদের হার বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সুদের হার কমিয়ে দিলে মানুষ অনেকবেশী পরিমান ঋন নেবে যার জন্য বাজারে অর্থের যোগান বেড়ে যাবে যার কারনে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবে এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাবে। কিন্তু তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইপে এরদোগান ভোটের জন্য সুদের হার অনেকটাই কমিয়ে দেয় যার জন্য কম সুদে অনেক বেশী মানুষ ঋন নেওয়া শুরু করে। রিসেপ তাইপে এরদোগানের লক্ষ্য তুরস্ককে মুসলিম বিশ্বের প্রধান করা। ইসলামে রয়েছে সুদ নেওয়া হারাম। এই জন্য এরদোগান সুদের হার অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া এরদোগান বিলাসবহুল বাড়ি, শপিং মল, মসজিদ সহ একাধিক বড় পরিকাঠামো নির্মান করাচ্ছে তুরস্ক জুড়ে। তুরস্কের এরকম অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ৬১৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করে তুরস্কের বিলাসবহুল পরিকাঠামো নির্মানের  সরাসরি প্রভাব পরেছে তুরস্কের অর্থনীতিতে। যেকোনও উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সর্বদা স্বাধীনতা প্রয়োজন যাতে ব্যাঙ্ক দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রন করতে পারে। যেমন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক আরবিআই বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া স্বাধীন ভাবে কাজ করে কিন্তু তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সরাসরি তুরস্ক সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে। তুরস্কের অর্থনীতির দুরাবস্থার জন্য এটাও একটা বড় কারন। 

তুরস্কের অর্থনীতির দুর্দশাকে পাকিস্তানের সাথে তুলনা করছে বিশ্বের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ গন। তুরস্ক ও পাকিস্তান দুই দেশের মধ্যেই মজবুত কুটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে তবে দুই দেশের মধ্যে আরও একটি বড় মিল হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার রাষ্ট্রপতি থাকার সময় থেকেই দুই দেশের সাথে আমেরিকার কুটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। আফগানিস্তানে তালিবানকে দমনের জন্য যুদ্ধ করছিলো আমেরিকা। কিন্তু প্রথমদিকে পাকিস্তান আমেরিকার পক্ষে থাকলেও পরবর্তীকালে পাকিস্তান তালিবানকে সমর্থন করা শুরু করে। এই জন্য আমেরিকার সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হওয়া শুরু করে পাকিস্তানের। আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ক গুলো থেকে পাকিস্তানকে কম সুদে ঋন দেওয়া বন্ধ করে। তাছাড়া আমেরিকা পাকিস্তানকে অনুদান দেওয়াও বন্ধ করে দেয়। একইরকম ভাবে সিরিয়াতে আমেরিকা চাইছিলো বাসার আল আসাদের সরকারের পতন ঘটানো, বাসার আল আসাদকে রাশিয়া সমর্থন করে। সেসময় ন্যাটের সদস্য হওয়া সত্বেও তুরস্ক রাশিয়ার পক্ষে গিয়ে বাসার আল আসাদকে সমর্থন শুরু করে। এই ঘটনায় আমেরিকা তুরস্কের বিরুদ্ধে চলে যায়। 

ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্কের অন্তর্ভুক্তি আটকে দেয় আমেরিকা। তুরস্কের অর্থনীতি যখন শক্তিশালী ছিল তখন অনেক দেশ থেকেই তুরস্ক ঋন নিচ্ছিল, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঋন নেওয়া তুরস্কের জন্য ক্ষতিকর সিদ্ধ হয়েছে। আমেরিকাতে বিনিয়োগ করলে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক একটি বন্ড কাগজ দেয় যাতে সুদের হার লেখা থাকে। একটা সময় আমেরিকাতে সুদের হার কম ছিল যার জন্য বেশী লাভের জন্য আমেরিকা ও ইউরোপীয়ান সংস্থা গুলো তুরস্কতে বিনিয়োগ করতো। কিন্তু আমেরিকা সুদের হার বৃদ্ধি করায় ওইসব সংস্থাই তুরস্ক থেকে অর্থ তুলে নিয়ে আমেরিকাতে বিনিয়োগ করে কারন নিরাপদ বিনিয়োগ স্থান হিসাবে আমেরিকা তুরস্ক অপেক্ষা অনেকবেশী নিরাপদ। এত বেশী অর্থ তুরস্ক থেকে বেড়িয়ে যাওয়ায় এর ঋনাত্মক প্রভাব পড়েছে তুরস্কের অর্থনীতিতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *