কমিউনিস্ট চীন ও বর্তমান চীনের মধ্যে অনেক তফাৎ। কমিউনিজম কেন কোনও দেশের জন্য অভিশাপ নাকি আশীর্বাদ?
১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট দুইশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের পর ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়। সংবিধানে ভারতকে গনতান্ত্রিক দেশ বলা হয়েছে। যদি সেসময় ভারত গনতান্ত্রিক দেশ না হয়ে কমিউনিস্ট দেশ হত তাহলে বর্তমানে হয়ত ভারতের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো পুরো ভেঙ্গে পড়ত। কমিউনিজম যেদেশে গেছে সেই দেশের জন্যই অভিশাপ নিয়ে এসেছে। কমিউনিজমের উৎপত্তি যেদেশ থেকে হয়েছে সেই সোভিয়েত ইউনিয়নই ১৯৯১ সালে ভেঙে গেছে। যা প্রমান করে কমিউনিজমের ব্যর্থতা।
গনতন্ত্রে মানুষের কাছে স্বাধীন নাগরিক অধিকার থাকে, দেশের সরকার নির্বাচনের অধিকার থাকে, সরকারের কোনও নীতি পচ্ছন্দ না হলে সমালোচনা করার অধিকার থাকে। গনতন্ত্রে সবার সমান অধিকার থাকে। বর্তমানে বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা গনতান্ত্রিক মতবাদে বিশ্বাস করে। ভারতকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গনতান্ত্রিক দেশ বলা হয়। কমিউনিজম শব্দের অর্থ সাম্যবাদ। কমিউনিজম এমন এক চিন্তাধারা যেখানে বলা হয় ধনী গরীবের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ থাকবেনা, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সমান হবে এবং কোনও শাসক থাকবেনা। কার্ল মার্ক্সকে কমিউনিজমের জনক বলা হয়। মূলত উনিশ শতকে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সময় কমিউনিজমের উৎপত্তি হয়। এই সময় ১৮৪৮ সালে কার্ল মার্ক্স কমিউমিস্ট মেনিফেস্টোর মাধ্যমে সাম্যবাদের প্রচার করেছিল। শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপে ধনী ও গরীবের মধ্যে ব্যবধান অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এই ঘটনা আরও প্রবল আকার ধারন করে বিংশ শতকে। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়, দীর্ঘদিন যুদ্ধের কারনে ইউরোপের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো পুরো ভেঙে পড়ে। ফলে গরীব আরও গরীব হতে শুরু করে এবং এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে ধনী আরও ধনী হতে থাকে। যার জন্য কমিউনিটির সেসময় ইউরোপে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, নরওয়েজিয়ান মতোন দেশে কমিউনিজম ছড়িয়ে পড়ে। তবে ইউরোপে প্রকৃত কমিউনিজমের সূচনা হয় রাশিয়ার ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে।
১৯১৭ সালে ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লব হয় রাশিয়াতে এবং রাশিয়ার শাসক বা জারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ভ্লাদিমির লেনিন সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করে এবং কমিউনিস্ট দলকে সরকার ক্ষমতায় আসে। এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের প্রথম কমিউনিস্ট দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশে লেনিনের কমিউনিস্ট মতাদর্শকেই অনুসরন করা হয়।
বর্তমানে বিশ্বের পাঁচটি দেশ কিউবা, চীন, উত্তর কোরিয়া, লাওস ও ভিয়েতনামে কমিউনিজম রয়েছে। এসব দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় রয়েছে, কোনও বিরোধী দল নেই এখানে। শুধুমাত্র দলের মধ্যে নেতা পরিবর্তন হয়। এসব দেশে মানুষের কাছে ভোট দেওয়ার অধিকার নেই, তারা তাদের নেতা নির্বাচন করতে পারেনা। এসব দেশে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই, এখানকার মানুষের সরকারের কোনও নীতিকে সমালোচনার কোনও অধিকার নেই। তবে চীনের অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক উন্নয়নকে দেখে অনেকেই মনে করে ভারতেও কমিউনিজমকে দরকার। কিন্তু মানুষ কমিউনিজমের অন্ধকার দিক সম্পর্কে তেমন জানেনা। কমিউনিস্ট দেশে সরকার যদি কোনও নীতি তৈরি করে তাহলে তার বিরোধীতাতো দূরের কথা কেউ প্রতিবাদ করারও সাহস পায়না। গনতান্ত্রিক দেশে যেমন সরকার কোনও নীতি বা আইন পাশ করালে সেই নীতি যদি দেশের পক্ষে ততটা কার্যকর না হয় তাহলে জনগন পথে নেমে আন্দোলন শুরু করে যাতে সরকার চাপে পড়ে আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। তবে গনতন্ত্রের থেকে কমিউনিজমে দুটি ভালো দিক আছে তাহল নির্বাচন ও পরিকল্পনা।
ভারতের মতো দেশে প্রতি পাঁচবছর অন্তর লোকসভা নির্বাচন হয়, ঠিক তেমনি বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হয়, পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়, পৌরসভা নির্বাচন হয়। সবমিলিয়ে প্রতি দুইবছরে কোনও না কোনও নির্বাচন হতেই থাকে যার জন্য একটি বড় অঙ্কের অর্থ খরচ হয় কিন্তু কমিউনিস্ট দেশে এরকম নির্বাচন হয়না যার জন্য বিপুল অর্থ খরচও হয়না। এছাড়া গনতান্ত্রিক দেশে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক প্রকল্পও আটকে যায় কিন্তু কমিউনিস্ট দেশে যেহেতু বিরোধীপক্ষ থাকেনা সেজন্য সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে পারে। এটা শুনে হয়ত মনে হতে পারে তাহলে ভারতবর্ষে হয়ত কমিউনিজমের প্রয়োজনীয়তা আছে কিন্তু তার আগে মুদ্রার বিপরীত পিঠ জানাও প্রয়োজন। কমিউনিজমের এই সুবিধাই তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতারও কারন। যেমন যদি কোনও দেশের কমিউনিস্ট সরকারের দ্বারা তৈরি দেশের অর্থব্যবস্থার জন্য তৈরি কোনও নীতি ব্যর্থ হয় তাহলে দেশটির জনগন চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারন তাদের কাছে কোনও বিকল্প থাকেনা। এর ফলে দেশটির অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়ে, দেশটিতে দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
কমিউনিস্ট দেশে অতীতে এরকম ঘটনা অনেকবারই ঘটেছে। যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জোসেফ স্তালিনের শিল্পবিপ্লব নিয়ে ভুল নীতির কারনে দেশটিতে অন্তত ২০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। আবার চীনে মাও জেডং এর গ্রেট লীপ ফরওয়ার্ড নীতির করনে ৪৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল অর্থাৎ কমিউনিজম অত্যাচারী ডিক্টেটরশিপের জন্ম দেয়। কিন্তু গনতান্ত্রিক দেশে যদি সরকারের অর্থনীতি ব্যর্থ হয় তাহলে পাঁচবছর পর সরকার পরিবর্তনের সুযোগ থাকে মানুষের কাছে। ভারতের কমিউনিস্ট দলগুলো সরকার বিরোধীতা করতে গিয়ে চীনের উন্নয়নের উদাহারন দেয়। আসলে ভারতের কমিউনিস্ট দলগুলো প্রকৃত সত্য কখনওই ভারতবাসীকে জানতে দিতে চায়না। কমিউনিস্ট নেতা মাও জে ডং এর নেতৃত্বে চীনের গঠন হলেও আধুনিক চীন মাও জেডং এর আগ্রাসী কমিউনিজম থেকে অনেকটাই সরে এসেছে।
১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত চীনে মাও জেডং এর আগ্রাসী কমিউনিজমের করনে চীনের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়নি। যার জন্য চীনের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ড্যাং জিওপিং বুঝতে পারে কমিউনিজম তার দেশের ধ্বংসের কারন হবে। সেজন্য ড্যাং জিওপিং চীনে নতুন আর্থিক নীতি শুরু করে। ড্যাং জিওপিং পুঁজিবাদকে কমিউনিজমের সাথে যুক্ত করে এক উদার কমিউনিজম তৈরি করে যা আধুনিক চীন গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। ড্যাং জিওপিং বিভিন্ন দেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করে দেশে আর্থিক সংস্কারের জন্য বিদেশী সংস্থাগুলোকে চীনে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়। এছাড়া চীন জাপান, আমেরিকা থেকে প্রযুক্তি কিনে দেশে দক্ষ শ্রমিক তৈরি করে এবং উৎপাদনে জোর দেয়। কমিউনিস্ট মতাদর্শ থেকে সরে আসার পরেই ১৯৯০ সালের পর থেকে চীনের বিদ্যুৎ গতিতে উত্থান শুরু হয়েছে। ১৯৯০ সালে চীনে যেখানে ৩.৪ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে সেখানে ২০১৯ সালে চীনে ১৫৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে। ২০১৩ সালে চীনে রেকর্ড পরিমান বিদেশী বিনিয়োগ এসেছিল প্রায় ২৯০ বিলিয়ন। এই কারনেই চীন বর্তমানে আমেরিকার পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। কমিউনিজম থাকাকালীন ১৯৭৮ সালে চিনের জিডিপি ছিল ১৫০ বিলিয়ন ডলার, ২০২৩ সালে সেই চীনের জিডিপিই ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ কমিউনিজম একটি রাষ্ট্রের জন্য কতটা অভিশাপ তা এই ঘটনা থেকেই স্পষ্ট।
সমস্ত কমিউনিস্টদের কাছেই চীন একটি বড় উদাহারন কিন্তু বাস্তবে চীন শুধু খাতায় কলমেই কমিউনিস্ট এটা তারা জানেনা। ড্যাং জিওপিং এর কারনেই চীনের সমস্ত আর্থিক নীতি তৈরি হয় পুজিবাদকে কেন্দ্র করে। মাও জেডং এর কমিউনিস্ট চীন ও বর্তমান চীনের মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে। এসব তথ্য ভারতের কমিউনিস্ট দলগুলো কখনওই জানাবেনা সাধারন মানুষকে। কমিউনিস্ট মতাদর্শ অনুযায়ী সমাজে কোনও বিভেদ থাকবেনা, কোনও শ্রেনীবিভাগ থাকবেনা, জনগনই সমস্ত ক্ষমতা নিয়ন্ত্রন করবে। কিন্তু চীনে প্রচুর বেসরকারী সংস্থা রয়েছে, চীনে বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আসে। অন্যদিকে কমিউনিজমে বিশ্বাসী উত্তরকোরিয়া আর্থিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে নীচের শ্রেনীর দেশগুলোর মধ্যে একটি। পুরো জগৎ থেকে বিচ্ছিন উত্তরকোরিয়াতে কিম জং উন নামক ডিক্টেটরের শাসন চলে। শুধু উত্তর কোরিয়া নয় লাওস, কিউবা, ভিয়েতনামের মতোন কমিউনিস্ট দেশে ব্যাপক দারিদ্র্যতা ও দূর্নীতি দেখা যায়। আজ যদি ভারতে কমিউনিজম থাকতো তাহলে ভারত কখনও বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হতনা, মানুষ দারিদ্র্যপীড়িত হয়ে পড়ত বলে মত বিশেষজ্ঞদের। আসলে কমিউনিজম শুনতে, পড়ত যতটা ভালোলাগে বাস্তবে এর প্রয়োগ ততটাই অসম্ভব।