চীন, পাকিস্তানকে নজরে রাখতে এবার AI ভারতবর্ষের
বর্তমানে মানব সভ্যতার প্রতিটি অঙ্গে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই সিস্টেম জড়িত। শিক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা, প্রযুক্তি সহ প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই এআই সিস্টেমের প্রভাব বাড়ছে বর্তমানে। ভারতীয় সেনাবাহিনীও সীমান্তে এবার এআই সিস্টেম ইনস্টল করেছে। এআই সিস্টেম এত আপগ্রেডেড হয়ে গেছে যে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর সব শক্তিশালী দেশের সেনাবাহিনী, বায়ুসেনা এবং নৌবাহিনী এআই ব্যবহার করবে। তবে অতিরিক্ত এআই ব্যবহার ভবিষ্যতে প্রতিটি দেশের সেনাবাহিনীতে সেনা সদস্য সংখ্যা কমিয়ে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
পাকিস্তান ও চীনের বিরুদ্ধে সক্ষমতা বাড়াতে ভারতীয় সেনাবাহিনী চীন ও পাকিস্তান সীমান্তে এআই সিস্টেম যুক্ত নজরদারি ব্যবস্থা ইনস্টল করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আধুনিকরন করা হচ্ছে যাতে সেনাবাহিনী যেকোনও পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবার জন্য যুদ্ধবিমান, ড্রোন, সাবমেরিন সহ একাধিক অস্ত্র কেনা হচ্ছে তবে তার পাশাপাশি ভারতের দীর্ঘ সীমান্তকে সুরক্ষিত রাখবার জন্য এআই সিস্টেমেরও ব্যবহার শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সীমান্ত যাকে লাইন অফ কন্ট্রোল বা এলওসি বলা হয় এবং পূর্ব দিকে চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত যাকে লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি বলা হয়, এই দুই সীমান্তে চব্বিশ ঘন্টা নজরদারি প্রয়োজন।
ভারতের সাথে পাকিস্তান ও চীনের বিশাল সীমানা রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ৩,৩২৩ কিলোমিটার বা ২,০৬৫ মাইল বিশাল লম্বা সীমান্ত রয়েছে। ভারতের চারটি রাজ্য পাঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাট ও জম্মু এবং কাশ্মীরের সাথে পাকিস্তানের সীমানা রয়েছে। পাঞ্জাবের সাথে ৫৫৩ কিলোমিটার, রাজস্থানের সাথে ১,০৩৫ কিলোমিটার, গুজরাটের সাথে ৫১২ কিলোমিটার এবং জম্মু ও কাশ্মীরের সাথে ১,২১৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে পাকিস্তানের। জম্মু ও কাশ্মীরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ৭৪০ কিলোমিটার থেকে ৭৭৬ কিলোমিটার লম্বা সীমানাকে এলওসি বলা হয়। ভারত পাকিস্তান সীমান্তে প্রায় ৫০,০০০ পোলে দেড় লাখ ফ্লাডলাইট লাগিয়েছে ভারত যা মহাকাশ থেকেও দেখা যায়। ভারতের হিমাচল প্রদেশ, লাদাখ, সিকিম ও অরুনাচল প্রদেশের সাথে চীনের ২,১৬৭ মাইল বা ৩,৪৮৮ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত রয়েছে। এছাড়াও ভারতের সাথে মায়ানমার, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তানের লম্বা সীমানা রয়েছে। ভারতের যত দেশের সাথে স্থল সীমানা রয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন চীন ও পাকিস্তান সীমানা নজরদারি করা। এত বিশাল লম্বা সীমান্ত শুধুমাত্র মানুষের দ্বারা নজর রাখা সম্ভব নয়, এখানেই দরকার এআই সিস্টেমের।
ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্তে ১৪০ এআই নজরদারি ব্যবস্থা ইনস্টল করেছে। এই এআই নজরদারি ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে সেন্সর, রেডার, ড্রোন, হাই রেজুলেশন ক্যমােরা। এসব সিস্টেমে বিশেষ এআই সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে যাতে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানেও সহায়তা করবে। ভারতের যে সাতটি দেশের সাথে স্থল সীমান্ত আছে তার মধ্যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সীমান্তে সবচেয়ে বেশী চোরাকারবারি, মাদকের ব্যবসা হয়, বিশেষ করে পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত জঙ্গিরা ভারতে প্রবেশ করে নাশকতার চেষ্টা করে। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা বিএসএফ বিভিন্ন সময়ে অপারেশন করে অনেক চোরাকারবারিদের গ্রেফতার করে। পাকিস্তানি সন্ত্রাসী সংগঠন গুলো বর্তমানে অভিনব কায়দায় ড্রোনের মাধ্যমে অর্থ, অস্ত্র ও মাদক পাঠাচ্ছে সীমান্ত টপকে।
২০১৯ থেকে এখনও পর্যন্ত বিএসএফ ও পাঞ্জাব পুলিশ অন্তত ৮২ টি ড্রোন বাজেয়াপ্ত করেছে। গত চার বছরে ভারত পাকিস্তান সীমান্তে অন্তত ৫৯৩ বার ড্রোন দেখা গেছে। ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থার এক সদস্য জানিয়েছেন গত এক বছরে ভারত পাকিস্তান সীমান্তে ড্রোনের মাধ্যমে অবৈধ ভাবে ভারতে পাঠানের চেষ্টা করা হয়েছিল ৩১৭ কেজি হেরোইন, ১০ কেজি আরডিএক্স, ১০ টি আইইডি, ৫১২ টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৫৬ হ্যান্ড গ্রেনেড, ১২ টি একে৪৭, ১২৮ পিস্তল এবং ১৮ লাখ টাকা যা নিরাপত্তা সংস্থা বাজেয়াপ্ত করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় জানিয়েছে বিগত কয়েক বছরে ড্রোন দেখা গেছে মূলত ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সীমান্তে ২ থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে। ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের সাথে পাকিস্তানের ৫৫৩ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে যার মধ্যে ৩৫ কিলোমিটার নদী অঞ্চল। সূত্র অনুযায়ী পাকিস্তানি চোরাচালান কারবারিরা ড্রোনের মাধ্যমে ভারতের দিকে খলিস্তানপন্থী সংস্থাগুলিকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করার চেষ্টা করছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর সহায়তায়। গত জুলাই মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের প্রাক্তন প্রতিরক্ষা বিষয়ক সহকারী মালিক মোহাম্মদ আহমেদ খান একটি সাক্ষাৎকারে জানায় পাকিস্তানি চোরাকারবারীরা ভারতে মাদক পাঠানোর জন্য ড্রোন ব্যবহার করছে।
পাঞ্জাবে মাদক চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে পাঞ্জাব পুলিশ ইতিমধ্যেই ৩০ জনকে গ্রেফতার করেছে। ২০২৩ এর গত দশ মাসে এনএসজি ভারতের দশটি রাজ্যের পুলিশ ও তিনটি কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীকে অ্যান্টি ড্রোন প্রশিক্ষন দিয়েছে। এই কারনে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক যত দ্রুত সম্ভব পাকিস্তান ও চীন সীমান্ত এআই সিস্টেম ব্যাবহার করে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা শুরু করেছে। ধাপে ধাপে ভারতের সমস্ত প্রতিবেশী দেশ গুলোর সাথে সীমানাতেই এআই সিস্টেম ইনস্টল করা হবে। এআই লজিস্টিক, তথ্য, বিশ্লেষন সমস্ত কাজেই সেনাবাহিনীকে সহায়তা করে। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্সের মতোন সামরিক শক্তিশালী দেশগুলোও তাদের সেনাবাহিনীতে এআই সিস্টেম যুক্ত করছে। এআই ড্রোন ও রোবট বিশেষ সীমান্ত এলকায় পেট্রোলিং করতেও সক্ষম ফলে এরকম জায়গায় সেনা সদস্যের বদলে এআই কাজ করবে, এতে প্রানহানির ঝুঁকি কমবে। যেমন চীনের সাথে গালওয়ান উপত্যকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর যে সংঘর্ষ হল সেখানের বিশেষ পেট্রোলিং পয়েন্টে সেনা সদস্যের বদলে ড্রোন ও রোবট পাঠানো যেতে পারে অদূর ভবিষ্যতে।
সম্প্রতি ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং গত জুলাই মাসে হওয়া এআই ইন ডিফেন্স সম্মলনে ৭৫ টি নতুন এআই প্রযুক্তি লঞ্চ করেছেন যেমন রোবটিকস প্রযুক্তি, অটোমেশন টুলস, বিশেষ নজরদারি ব্যবস্থা ইত্যাদি। ভারত ও আমেরিকা এআই সিস্টেম এবং সাইবার সিকিউরিটি প্রশিক্ষনের উপর একসাথে কাজ করছে। ২০২৩ সালের শুরুতেই ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত হওয়া এরো ইন্ডিয়াশোতে ভারতের নিজস্ব তৈরি এআই সফটওয়্যার অগ্নি ডিকে প্রদর্শন করা হয়। ইতিমধ্যেই পূর্ব লাদাখে এই সফটওয়্যার ব্যবহার করছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। চীনের সীমান্তের কাছে অবস্থিত হওয়ায় পূর্ব লাদাখ স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভারতের কাছে। এই সফটওয়্যার সীমান্তে চীনের সেনাবাহিনীর গতিবিধি, অস্ত্র, মিসাইল, ট্যাঙ্ক ও গাড়ির গতিবিধির উপর নজরদারি করতে সক্ষম। শুধু ভারত একা নয় চীনও দ্রুত এআই সিস্টেম তার সেনাবাহিনীতে যুক্ত করছে। একটি সমীক্ষায় জানা গেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রতিবছর ৫০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার ব্যায় করছে এআই সিস্টেমের উপর কিন্ত চীন ভারতের তুলনায় ত্রিশ গুন বেশী খরচ করছে এআই সিস্টেমে। সুতরাং এআই সেক্টরে ভবিষ্যতে আরও বেশী বিনিয়োগ করতে হবে ভারতকে। ভবিষ্যতের পঞ্চম প্রজন্মের ওয়ারফেয়ার পুরো এআইএর উপরেই হবে, ড্রোন, যুদ্ধজাহাজ, হেলিকপ্টার, যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন সবকিছু এআই এর ব্যবহার হবে। সুতরাং যে দেশের এআই সিস্টেম যত আধুনিক হবে সেই দেশ তত শক্তিশালী হবে। তবে সম্পূর্ন ভাবে এআই সিস্টেমের উপর নির্ভরশীল হওয়া বড় বিপদের কারন হতে পারে যার সবচেয়ে বড় উদাহারন গত ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া হামাস ও ইসরায়েলের যুদ্ধ। ইসরায়েলের প্রযুক্তি ও নজরদারি ব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ, সেই ইসরায়েলই বুঝতে পারেনি গত ৭ অক্টোবর হঠাৎ করে হামাস কুড়ি মিনিটে প্রায় পাঁচ হাজার রকেট ছোঁড়ার কথা ইসরায়েলের দিকে যাতে বহু ইসরায়েলি নাগরিকের মৃত্যু হয়। সুতরাং এআই এর উপর সম্পূর্ন নির্ভরতা কখনওই সম্ভব নয় কিন্তু এআই যে ভবিষ্যত এটা নিশ্চিত।