অফবিট

পৃথিবীর শেষ দিন কি শীঘ্রই আসতে চলেছে

ইন্টারনেটে বহু মানুষ একটি তথ্য খোঁজে যে শেষের দিন বা কেয়ামত কা দিন কবে আসবে অর্থাৎ মানব জাতির শেষ কবে হবে। এর উত্তর খুঁজে বের করবার জন্য বিজ্ঞানীরা একটি ঘড়ি বানিয়েছে যার নাম ডুমসডে ক্লক। এই ঘড়ি যেসব বৈজ্ঞানিকরা বানিয়েছে তাদের মধ্যে একজন হলেন স্টিফেন হকিংস, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের পর তাঁকেই বিশ্বের অন্যতম মহান বৈজ্ঞানিক বলা হয়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছে এই ডুমস ডে ঘড়িতে যখন বারোটা বাজবে তখন বিশ্ব শেষ হয়ে যাবে। এখন ওই ঘড়িতে সময় ১১ টা ৫৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড। অর্থাৎ মানবজাতির ধ্বংস হতে দেরী মাত্র একশো সেকেন্ড!! এটা শুনে মনে হবে বোধহয় এক্ষুনি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে!! কিন্তু ডুমস ডে ঘড়িতে সময়ের মাপদন্ড আলাদা, এই ঘড়ির গঠন ও ভিন্নরকম। 

ডুমসডে ঘড়ি কোন সাধারন হাতে পড়ার ঘড়ি নয়, এই ঘড়ি বাড়ির দেওয়ালে সাজিয়ে রাখারও নয়। এটি একটি যন্ত্র, এই ঘড়িতে সময় বারোটার কাছাকাছি পৌঁছানোর অর্থ মানব জাতির অস্তিত্ব তত সংকটে পড়া। ঘড়ির কাঁটা বারোটা থেকে যতদূরে থাকবে তার অর্থ মানবজাতির অস্তিত্ব বেশীদিন বজায় থাকবে। ১৯৯১ সালে এই ঘড়ির কাঁটা বারোটা থেকে সবচেয়ে বেশী দূরে ছিল। এই ঘড়ির সময় সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে এর ইতিহাস সম্পর্কে জানা দরকার। 

১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। অ্যাডলফ হিটলারের অপারেজয় জার্মান নাজি সেনার সামনে ইউরোপের একের পর এক দেশ পরাজিত হচ্ছে। অবস্থা এমন হয়ে যায় যে ইংল্যান্ড বাদে বাকী সব ইউরোপীয়ান দেশই জার্মানির অধীনে চলে যায়। এইসময় আমেরিকা ও জর্মান বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে পরমানু বোম্ব তৈরি করার একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। আমেরিকার পক্ষে রবার্ট ওপেনহাইমার এবং জার্মানির পক্ষে ওয়ার্নার হাইসেনবার্গ পরমানু বোম্ব তৈরি করার চেষ্টা করছিলো। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই রবার্ট ওপেনহাইমার সফল ভাবে পরমানু বোম্ব পরীক্ষা করে। এর কুড়ি দিন পরে ৬ আগস্ট ও ৯ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমানু বোম্ব পরীক্ষা করে আমেরিকা, যার ধ্বংসলীলা দেখে সাথে সাথে জাপান আত্মসমর্পন করে এবং শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপানে পরমানু বোম্বের প্রভাব এখনও রয়েছে, হিরোশিমা ও নগাসাকি শহরে আজও প্রতিবন্ধী বাচ্ছার জন্ম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার সাথে সাথে বিশ্বে পরমানু অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়, আমেরিকার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও চীন পরমানু অস্ত্র তৈরি করে ফেলে। তবে সবচেয়ে প্রথমে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছেই সবচেয়ে বেশী পরমানু অস্ত্র ছিল। আবার এই দুটি দেশের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। তাই ১৯৪৭ সালে বিএএস বা বুলটিন অফ অ্যাটমিক সায়েন্টিস্ট নামে সংস্থা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কিছু বিজ্ঞানীকে ডেকে জানায় এমন কিছু তৈরি করতে যাতে ভবিষ্যতে মানবজাতি বুঝতে পারে তাদের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধাস্ত্রের কারনে তাদের শেষের দিন কত তাড়াতাড়ি আসছে। সেসময় নোবেল জয়ী পনেরো জন বৈজ্ঞানিক মিলিত ভাবে এই ডুমস ডে ঘড়ি তৈরি করেছিল। ঘড়িটি তৈরির সময় রাখা হয়েছিল এগারোটা তিপ্পান্ন মিনিট। এটা এই ঘড়ির মধ্যবর্তী সময় অর্থাৎ সময় এগারোটা তিপ্পান্নের থেকে কম হলে তা বিশ্বের জন্য ভালে কিন্তু সময় এগারোটা তিপ্পান্নের থেকে যত বেশী হবে তত মানব জাতির ধ্বংস নিকটে। তৈরির পর থেকে পরিস্থিতি অনুযায়ী এই ঘড়িতে সময় বহুবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এই পনেরো জন বিজ্ঞানী বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন পরিস্থিতি যেমন যুদ্ধ, মহামারী, পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা এসবে নজর রাখতো, তার উপর বিশ্লেষন করে এই ঘড়ির সময় পরিবর্তন করা হত। 

১৯৪৯ সালে এই ঘড়ির সময় করা হয় এগারোটা সাতান্ন মিনিট কারন এই বছর সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রথম পরমানু বোম্ব আরডিএস – ১ পরীক্ষা করে এবং আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল যার কারনে বিশ্ব রাজনীতিতে সংকট দেখা যায়। ১৯৫৩ সালে এই ঘড়ির সময় করা হয় এগারোটা আটান্ন মিনিট কারন এইবছর আমেরিকা হাইড্রোজেন বোম্ব পরীক্ষা করেছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন জেওই – ৪ নামক পরমানু অস্ত্রের পরীক্ষা করেছিল। ১৯৬০ সালে এই ঘড়িতে সময় আবারও এগারোটা তিপান্ন করা হয় কারন ১৯৬০ আসতে আসতে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো বুঝতে পেরেছিল পরমানু বোম্বের অপকারতার কথা, যার জন্য পরমানু নিরস্ত্রীকরন চুক্তি শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে এই ঘড়িতে সময় করা হয় এগারোটা আটচল্লিশ মিনিট কারন এই বছর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল নতুন করে পরমানু বোম্বের পরীক্ষা না করার। 

১৯৬৮ সালে এই ঘড়িতে সময় হয় আবারও এগারোটা তিপ্পান্ন মিনিট কারন বিগত বেশ কয়েক বছরে বিশ্বে অনেক পরিবর্তন হয়। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হয়, ইসরায়েল ও আরবদেশ গুলোর মধ্যে ছয়দিনের যুদ্ধ হয়। আমেরিকা ভিয়েতনামের যুদ্ধ হয়। ফ্রান্স ও চীন পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ চুক্তিতে সই করতে অস্বীকার করে যার কারনে ডুমস ডে ঘড়িতে সময় বেড়ে যায়। ১৯৬৯ সালে আবার সময় কমে হয় এগারোটা পঞ্চাশ। কারন এই বছর ভারত, পাকিস্তান ও ইসরায়েল ছাড়া বাকি সমস্ত দেশ পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা না করার চুক্তিতে সই করে দিয়েছিল। 

১৯৭২ সালে ঘড়িতে সময় হয় এগারোটা আটচল্লিশ। কারন এই বছর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ন চুক্তি হয়, সল্ট – ১ চুক্তি যাতে দুই দেশ তাদের সেনাবাহিনীর সংখ্যা কমিয়ে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় আনতে সক্ষম হয় এবং এবিএম বা অ্যান্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল চুক্তি। ১৯৭৪ সালে ঘড়িতে সময় বেড়ে হয় এগারোটা একান্ন কারন এইবছর ভারত তাদের প্রথম পরমানু পরীক্ষা অপারেশন স্টাইলিং বুদ্ধা করে এবং আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের মিলিটারি গাড়ি, সাবমেরিন, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান আপগ্রেড করা শুরু করে। 

১৯৮০ সালে ডুমস ডে ঘড়িতে সময় হয় এগারোটা তিপ্পান্ন কারন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সেনা পাঠিয়েছিল। তার পরের বছরই ১৯৮১ সালে সময় হয় এগারোটা ছাপান্ন কারন এবছর অনেক ঘটনা ঘটে, সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান যুদ্ধ যার অর্থ সল্ট – ১ চুক্তি ভেঙে যাওয়া, রাশিয়াতে হওয়া গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে আমেরিকার অংশ না নেবার ঘোষনা করা, চীনের বেশ কিছু পরমানু বোম্ব পরীক্ষা করা, ইরান-ইরাক যুদ্ধ  এবং আমেরিকার নতুন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রেগানের সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধমকানো যার কারনে ডুমস ডে ঘড়িতে সময় ক্রমশ খারাপ দেখায়। ১৯৮৪ সালে সময় হয় এগারোটা সাতান্ন কারন এই বছর আমোরিকার রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রেগান পশ্চিম ইউরোপ ক্রুজ মিসাইল ও ব্যালিস্টিক মিসাইল মোতায়েন করে যার অর্থ সোজা সোভিয়েতে আক্রমন করা। এবছর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯১ সালে সময় হয় এগারোটা তেতাল্লিশ, ডুমস ডে ঘড়ি তৈরি হবার পর এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো সময় গেছে ১৯৯১ সালে। কারন ১৯৯১ আসতে আসতে জার্মানিতে বার্লিনের প্রাচীর ভেঙে দেওয়া হয় এবং পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানি এক হয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধের শেষ হয় কারন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পনেরোটি দেশ গঠন হয়, যার কারনে বিশ্বে পুনরায় শান্তি স্থাপন হয়। এরপর ১৯৯৮ সালে আবারও ডুমস ডে ঘড়িতে সময় বেড়ে হয় এগারোটা একান্ন কারন এই বছর ভারত পোখরান ২ পরীক্ষা করেছিল এবং পাকিস্তান ছাগাই ১ পরমানু পরীক্ষা করেছিল। আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর রাশিয়াও নিজের শক্তি বাড়াতে শুরু করেছিল, সাথে বিশ্বের বাকী দেশ গুলোও নিজেদের সৈন্য শক্তি বাড়াতে শুরু করেছিল। 

২০০৭ এ ঘড়িতে সময় হয় এগারোটা পঞ্চান্ন কারন এই বছর উত্তর কোরিয়া পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করে, আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। যার কারনে দুই দেশই নিজেদের পরমানু অস্ত্রের পরিমান বাড়াতে শুরু করে। ২০০৭ সালে আমেরিকা ও রাশিয়ার কাছে মিলিত পরমানু অস্ত্রের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬,০০০  গোটা পৃথিবীকে কয়েক বার ধ্বংস করতে সক্ষম। তাছাড়া এই বছর থেকেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখা দিতে শুরু করে। ২০১২ থেকে ২০১৫ মধ্যে ডুমস ডে ঘড়িতে সময় আরও বেড়ে গিয়ে হয় এগারোটা সাতান্ন কারন জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়, পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশ কার্বনের মাত্রা কমানোয় তেমন কিছুই পদক্ষেপ নিচ্ছিল না এবং পৃথিবীর বহু দেশই পরমানু ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করছিলো। ২০১৮ তে সময় আরও বেড়ে গিয়ে হয় এগারোটা আটান্ন মিনিট, কারন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে আমেরিকাকে বের করে দেয়, যার অর্থ বিশ্বে কার্বনের পরিমান বাড়লেও আমেরিকার কোন সমস্যা নয়। রাশিয়া, আমেরিকা তাদের পরমানু অস্ত্র আপগ্রেড করা শুরু করে। ২০২৩ এ ডুমস ডে ঘড়িতে সময় দাঁড়িয়েছে এগারোটা আটান্ন মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড অর্থাৎ শেষের দিন আসতে মাত্র নব্বই সেকেন্ড দূরে। ডুমস ডে ঘড়ি তৈরি হবার ৭৬ বছর ইতিহাসে এত খারাপ সময় কখনও আসেনি। 

বিশ্ব রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন দেখা গিয়েছে বিগত কয়েক বছরে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়ার পরমানু অস্ত্র ব্যাবহারের সম্ভবনা, চীনের সাথে আমেরিকা সহ একাধিক দেশের বিবাদ, উত্তর কোরিয়ার পর পর পরমানু মিসাইল পরীক্ষা, মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক সংকট, আফগানিস্তান, পাকিস্তানে সন্ত্রাসী সংগঠন গুলোর অবাধ বিচরন, করোনা মহামারীর কারনে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব, সাইবার ওয়ারফেয়ার যার কারনে মানব জাতির অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *