আমেরিকার সেনাদের পৃথিবীর সবথেকে ভয়ঙ্কর কেন বলা হয়?
এশিয়া মহাদেশে এমন এক দেশ আছে যাকে বলা হয় সাম্রাজ্যের কবরস্থান, দেশটির নাম আফগানিস্তান। বলা হয় আফগানিস্তানকে জেতা সম্ভব নয়। এর প্রধান কারন আফগানিস্তানের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য। আফগানিস্তানে ৮০ শতাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে পাহাড়। পাহাড় ও জঙ্গল গোরিলা যুদ্ধের জন্য আদর্শ। ১৮৩৮ সালে ব্রিটিশরা আফগানিস্তান আক্রমন করে ১৮৩৮ থেকে ১৮৪২ অবধি প্রথম অ্যাংলো আফগান যুদ্ধ হয় যাতে ব্রিটিশ সেনা বাধ্য হয়ে পীছু হটে।
১৮৭৮ সালে দ্বিতীয় অ্যাংলো আফগান যুদ্ধ হয়, দুই বছরের এই যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশরা জয়ী হয়। ১৯১৯ সালে তৃতীয় অ্যাংলো আফগান যুদ্ধ হয় যাতে আফগানিস্তান জয়ী হয়। এরপর আসে ১৯৭৯ যখন আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি হয় হাফিজুল্লাহ আমিন। কিন্তু তার নেওয়া একাধিক পদক্ষেপের বিরোধীতা করতে শুরু করে আফগানিস্তানের মানুষ যার কারনে হাফিজুল্লাহ আমিনের বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সেনাবাহিনী পাঠায়। বিরোধী আফগানদের সাহায্য করতে শুরু করে আমেরিকা। অপারেশন সাইক্লোনের মাধ্যমে আফগানিদের রীতিমতো মিলিয়ন ডলার ও প্রচুর অস্ত্র সাহায্য করে আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স আমেরিকার সাথ দেয় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। পাকিস্তান আফগানিদের প্রশিক্ষন দেয়। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে সেনা ফিরিয়ে নেয় এবং এর দুবছরের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। কিন্তু আমেরিকা যাদের অস্ত্র দিয়ে শক্তিশালী করেছিল সেই আফগান মুজাহিদ্দিনরাই আমেরিকার বিরুদ্ধে চলে যায়।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার নিউইয়র্কের ট্যুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলা হয় যাতে তিন হাজারের বেশী মানুষ মারা যায়। এই ঘটনার পেছনে ছিল আল-কায়দা নামক সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রধান ওসামা বিন লাদেন। এরপরেই আমেরিকান সেনা আফগানিস্তানে যায়। কিন্তু আফগানিস্তানে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় অর্থাৎ যত শক্তিশালী দেশই হোক না কেন আফগানিস্তানকে জেতা সম্ভব নয়। বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ও শক্তিশালী আমেরিকান সেনাবাহিনীর উপর লুকিয়ে গোরিলা আক্রমন করতে শুরু করে তালিবান ও আল-কায়দা সন্ত্রাসীরা। বাধ্য হয় কুড়ি বছর পর ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আমেরিকান সেনা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায়। আফগানিস্তানে তালিবান ও আমেরিকান সেনাবাহিনীর মধ্যে একাধিক সংঘর্ষ হয়েছিল যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নুরিস্থান প্রদেশে হওয়া কামদেশের যুদ্ধ। আফগানিস্তানের কামদেশ গ্রামে চারশো সশস্ত্র তালিবান সেনা ঘিরে ফেলেছিল আমেরিকান সেনাদলকে। মাত্র আশি জন আমেরিকান সেনার সামনে চারশো জন তালিবান সেনা। কিন্তু সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা সত্বেও তালিবান সেনা পরাজিত হয় এই যুদ্ধে। কামদেশের যুদ্ধ প্রমান করেছিল কেন আমেরিকান সেনাবাহিনীকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘাতক ও শক্তিশালী বলা হয়।
হিন্দুকুশ পর্বতের কাছে অবস্থিত কামদেশ গ্রামের চারদিকে রয়েছে উঁচু পাহাড়, যার কারনে এই এলাকায় পাহাড়ের উপর থেকে গোরিলা যুদ্ধ করা খুবই সহজ। এই গ্রাম পাকিস্তান সীমান্তের কাছে অবস্থিত হওয়ায় আমেরিকান সেনা এখানে তাদের ক্যাম্প তৈরি করেছিল। আমেরিকান সেনাবাহিনীর দশম পর্বত ডিভিশন জুন, ২০০৭ এ এখানে ক্যাম্প তৈরি করে। পরে এই ক্যাম্পের নাম বেঞ্জামিন কিটিং রাখা হয়, যিনি তালিবানের সাথে শহীদ হয়েছিলেন। নুরীস্থান এলকার জনবসতি খুবই কম মূলত চারটি উপজাতিতে বিভক্ত এখানের জনগোষ্ঠী কম, কাতা, কুশতোজ এবং কালাশা। এখানে পাঁচটি ভাষা বলা হয়। খাদ্য, জল ও বিভিন্ন কারনে এই চার উপজাতির মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ হত এখানে। আমেরিকান সেনাবাহিনীকে এখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নুরীস্থান প্রদেশের মানুষদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করে তাদের পক্ষে করা। যার কারনে আমেরিকা প্রাথমিক ভাবে ১.৩৩ মিলিয়ন ডলার এখানে বিনিয়োগ করে রাস্তা নির্মান, জলের পাইপ তৈরির কাজে। আমেরিকা নুরীস্থান প্রদেশের অর্থিক সমৃদ্ধির জন্য কাজ করছিলো। কিন্তু তালিবান নেতা মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তালিবান সদস্যরা হাজী ইউনুস নামে এক ব্যাক্তিকে হত্যা করে যে আমেরিকার হয়ে এই এলাকার উন্নয়নে কাজ করছিল।
২৯ এপ্রিল, ২০০৭ এ কামদেশে এক বাড়ির সামনে একটি চিঠি পাওয়া যায় যাতে পশতুন ভাষায় লেখা ছিল যে আমেরিকার সেনাবাহিনীকে বিদ্যালয়, রাস্তা, জলের লাইন তৈরি সহ কোন কাজে সাহায্য করা যাবেনা, চিঠির নীচে মুজাহিদ্দিনদের সই ছিল। এরপরই আফগানিস্তান সরকার কামদেশে নিরাপত্তার জন্য আরও সেনা পাঠায় কিন্তু রাস্তায় আফগান সেনার কনভয়ে আক্রমন হয় যাতে অনেক সেনা মারা যায়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই আরও আমেরিকান বিশেষ সেনা কামদেশে উপস্থিত হয়। ২৬ জুলাই, ২০০৭ এ নুরীস্থানে আমেরিকান সেনা ও তালিবানের মধ্যে দুই দিনের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে আমেরিকার বায়ুসেনাও অংশ নিয়েছিল যার কারনে তালিবান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশ কিছু মুজাহিদ্দিন মারা যায়। এই যুদ্ধের পর কামদেশের মানুষের বিশ্বাস আমেরিকান সেনাবাহিনীর প্রতি আরও বেড়ে যায়। নভেম্বর মাসে নুরীস্থানে স্থানীয় প্রায় আটশো মানুষের একটি বৈঠক হয় যাতে একশো জন সদস্যের একটি দল গঠন করা হয় যাদের কাজ ছিল আমেরিকান সেনাবাহিনীকে স্থানীয় উন্নয়নে সাহায্য করা এবং এলাকার মানুষকে প্রয়জনীয় জিনিস সরবরাহ করা। কিন্তু অক্টোবর, ২০০৮ আসতে আসতে তালিবান বারবার গোরিলা আক্রমন করতে থাকে আমেরিকান ক্যাম্পে, এতে বেশ কিছু আমেরিকান সেনার মৃত্যুও হয়। রাস্তা নির্মানে বারবার বাধার সম্মুখীন হতে হয় কারন তালিবান বিস্ফোরনের মাধ্যমে রাস্তা উড়িয়ে দিত। ফলে ধীরে ধীরে কামদেশে আমেরিকান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প অনেক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এইজন্য আমেরিকান সেনাবাহিনীর উচ্চ আধিকারিকরা নির্দেশ দেয় কামদেশ থেকে আমেরিকান সেনাবাহিনীকে সরে আসতে।
আগস্ট, ২০০৯ এর মধ্যে ক্যাম্প খালি দেবার নির্দেশ দেওয়া হয় কিন্তু নিকটবর্তী কিছু এলাকায় আমেরিকান সেনাবাহিনী ও তালিবানের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে ক্যাম্প খালি করবার সময় পিছিয়ে যায়। ততদিনে আমেরিকান সেনাবাহিনী ঠিক করে স্থানীয় মানুষদের সাথে মিশে পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য শেষ চেষ্টা করবে। এরই মধ্যে স্থানীয় কিছু মানুষদের থেকে আমেরিকান সেনাবাহিনী খবর পায় তালিবান একটি বড় আক্রমনের পরিকল্পনা করছে ক্যাম্পের উপর এবং আক্রমন ততক্ষন পর্যন্ত চলবে যতক্ষন পর্যন্ত শেষ আমেরিকান সেনা মারা না যায়। কামদেশে আমেরিকান ক্যাম্পের তিনদিকে ছিল পাহাড় যার কারনে তালিবানের সুবিধা ছিল পাহাড়ের উপর থেকে আক্রমন করার। ৩ অক্টোবর, ২০০৯ ভোর তিনটেয় তালিবানের কিছু সদস্য গ্রামে এসে স্থানীয় মানুষদের অবিলম্বে গ্রাম ছাড়ার নির্দেশ দেয়। সকাল ছয়টা নাগাদ আমেরিকার ক্যাম্প লক্ষ্য করে একের পর এক আরপিজি চালাতে থাকে তালিবান। কিছুক্ষনের মধ্যেই ক্যাম্পের বাইরে পৌঁছে যায় প্রায় চারশো সশস্ত্র তালিবান সদস্য। ক্যাম্পে সেসময় ৭৯ জন আমেরিকান সেনা, ২ জন লাটাভিয়ান সেনা ও ৪২ আফগান সেনা ছিল। তালিবানকে দেখে ৪২ আফগান সেনা ভয় খেয়ে যায়। লাটাভিয়ান মিলিটারির দুজন সদস্য তাদের বারবার বোঝানো সত্বেও শেষপর্যন্ত আফগান সেনারা ভয়ে পালিয়ে যায় ক্যাম্প ছেড়ে এবং পালানোর আগে আমেরিকান সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয় ডিজিটাল ক্যামেরা, প্রোটিন ড্রিংঙ্ক ও খাদ্য নিয়ে যায় তারা। কোন দেশের সেনাবাহিনী যদি ভীতু, দুর্বল হয় তাহলে সেদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব থাকে।
আজ আফগানিস্তানে তালিবান শাসন চলছে যার বড় কারন ভীতু আফগান সেনা যারা প্রায় বিনাযুদ্ধেই আত্মসমর্পন করেছে তালিবানের কাছে। আফগান সেনা পালিয়ে গেলে ক্যাম্পে থাকা ৮১ জন সেনার দায়িত্ব এসে পড়ে স্টাফ সার্জেন্ট ক্লিন্টন রোমেশার উপর। রোমেশা প্রথমে পাঁচজন সেনাকে নিয়ে একটি দল তৈরি করে, রোমেশা স্বয়ং এবং এই পাঁচজন সেনা তালিবানের মেশিনগান দলকে লক্ষ্য করে গুলি চলাতে থাকে এবং কিছুক্ষনের মধ্যেই মেশিনগান দলের প্রত্যেক সদস্য মারা যায়। এবার রোমেশাকে লক্ষ্য করে তালিবান হ্যান্ড গ্রেনেড ও আরপিজি ছোঁড়ে এরপরেও রোমেশা ও তার দল থামে নি, তারা তালিবানের স্নাইপার দলকেও শেষ করে দেয়। সার্জেন্ট কার্টার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বারবার সেনাকে অস্ত্র সরবরাহ করছিলো। তালিবান আমেরিকান ক্যাম্পের বাইরের সীমানায় প্রবেশ করে ফেলেছিল কিন্তু আমেরিকান সেনাবাহিনীর বারংবার আক্রমনে তারাও এগোতে পারছিল না৷ বেশ কয়েকঘন্টা লড়াই চলার পর আমেরিকান বায়ুসেনার অ্যাপচি হেলিকপ্টার, এফ ১৫ যুদ্ধবিমান, এ ১০ বিমান ও বি ১ বোম্বার বিমান সহ উনিশটি বিমান এয়ারস্ট্রাইক করতে শুরু করে। যাতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় তালিবান।
প্রায় দশ থেকে বারো ঘন্টা লড়াই চলার পর পীছু হটে তালিবান। এরপরে অতিরিক্ত সেনাবাহিনী এসে পৌঁছালে তালিবান পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে আমেরিকান সেনাবাহিনীর আটজন সেনা মারা যায় এবং ২৭ জন আহত হয়। অন্যদিকে ১৫০ জনের বেশী তালিবান মারা যায় এবং ৭০ জন আহত হয়।
৪ ও ৫ অক্টোবর নুরীস্থানে আবারও মিলিটারি অপারেশন করে আমেরিকা যাতে বেঁচে যাওয়া বাকী তালিবানদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয়। ৬ অক্টোবর আমেরিকান বায়ুসেনা বোম্বিং করে কামদেশের ক্যাম্প ধ্বংস করে দেয়। কামদেশের যুদ্ধে আমেরিকারন সেনাবাহিনীর এই অসাধারন বীরত্বের জন্য তাদের সম্মানিত করা হয়। সার্জেন্ট রোমেশা ও সার্জেন্ট কার্টারকে মেডেল অফ অনার দেওয়া হয়্ পঞ্চাশ বছর পর আমেরিকার মিলিটারিতে একই যুদ্ধে জীবিত দুই ব্যাক্তিকে এই সম্মান দেওয়া হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সর্বোচ্চ সম্মান যেমন পরমবীর চক্র ঠিক তেমনি আমেরিকান সেনাবাহিনীতে সর্বোচ্চ সম্মান এই মেডেল অফ অনার।