জাপান আত্মসমর্পন না করলে জাপানের বিরুদ্ধে কি পরিকল্পনা করেছিল আমেরিকা? অপারেশন ডাউনফল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল জাপান। জাপান তার আধিপত্য বিস্তারের নেশায় আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দর আক্রমন করে। এর বদলা নিতে আমেরিকা পরমানু বোম্ব তৈরি শুরু করে। ৩০ মে, ১৯৪৫ সালে জার্মানির সর্বোচ্চ নেতা অ্যাডলফ হিটলারের আত্মহত্যার সাথে সাথে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে জার্মানি আত্মসমর্পন করতে চলেছে, ৭ মে জার্মানি আত্মসমর্পন করে। জার্মানির আত্মসমর্পনের মাধ্যমে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু তখনও জাপান তার আধিপত্য বিস্তার করেই চলেছিলো। জাপানকে প্রতিরোধের জন্য আগস্ট মাসে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পরমানু বোম্ব বিস্ফোরন করে আমেরিকা। এই পরমানু বিস্ফোরনের ভয়াবহতার কারনে জাপান নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করে আগস্ট মাসেই। কিন্তু যদি জাপান আত্মসমর্পন না করতো তাহলে জাপানের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বড় সামরিক আক্রমনের পরিকল্পনা করেছিল আমেরিকা, যার নাম দেওয়া হয়েছিল অপারেশন ডাউনফল।
দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ, আমেরিকা ও চাইনিজ সেনা বার্মা দখল শুরু করে জাপানিদের থেকে। ৩,৪০,০০০ ভারতীয় সেনা, এক লাখ ব্রিটিশ সেনা ও আশি হাজার আফ্রিকান সেনা যৌথভাবে বার্মাতে জাপানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমন করে, এই যুদ্ধে জাপানি সেনাবাহিনী পরাজিত হয়। ১৯৪৫ সালের মে মাসে বার্মার রাজধানী রাঙ্গুন দখল করে মিত্রশক্তি। এদিকে ১৯৪৪ সালের এপ্রিল মাস থেকে জাপান অপারেশন ইচিগো শুরু করে চীনে। পাঁচ লাখ জাপানি সেনা চীন আক্রমন করে, ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সিচান প্রদেশ বাদে প্রায় সমস্ত চীনের বড় প্রদেশই জাপানের দখলে চলে যায়। এই জাপানি আক্রমনে প্রায় চোদ্দ মিলিয়ন চীনা মানুষের মৃত্যু হয়। আবার এই সময় প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে আমেরিকা মারিয়ানা দ্বীপ সহ ফিলিপিন্স দখল করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের সাথে আমেরিকার শেষ বড় যুদ্ধ হয় ওকিনওয়া দ্বীপকে কেন্দ্র করে। এই যুদ্ধে আমেরিকার নৌবাহিনীর সাথে ব্রিটেনের নৌবাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় গ্রুপ অংশ নিয়েছিল। মিত্রশক্তির ১,৩০০ জাহাজ, ৪০টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, বোম্বার বিমান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে রকেট, বোম্ব নিক্ষেপ করা হতে থাকে ওকিনওয়া দ্বীপে জাপানি সামরিক বেস লক্ষ্য করে। মিত্রশক্তির নয়টি ক্রুজার ১৩,০০০ শেল নিক্ষেপ করে এই দ্বীপে। মিত্রশক্তির এই তীব্র আক্রমনে প্রায় ৯৭,০০০ জাপানি সেনা দ্বীপে বিভিন্ন গুহাতে লুকিয়ে পড়ে।
১ এপ্রিল, ১৯৪৫ সালে আমেরিকার চারটি সেনাদল ওকিনাওয়া দ্বীপে গিয়ে পৌঁছায় সরাসরি যুদ্ধের জন্য। পরবর্তী তিনমাস ধরে ৪৮৫ বর্গকিলোমিটার এই দ্বীপে উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়, ১,৭০,০০০ আমেরিকান সেনা এই ওকিনাওয়া দ্বীপে আক্রমনে গিয়েছিল। আমেরিকান সেনাবাহিনী গুহাতে লুকিয়ে থাকা জাপানি সেনাদের বের করতে আগুনের শিখা ব্যবহার শুরু করে, দীর্ঘ যুদ্ধের পর জাপানি সেনাবাহিনী এখানে পরাজিত হয়। এরই মধ্যে ৭ মে জার্মানি আত্মসমর্পন করায় ইউরোপে দীর্ঘদিন ধরে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। এরপরেই মিত্রশক্তি সিদ্ধান্ত নেয় জাপানকে জোর করে আত্মসমর্পন করাতেই হবে। আমেরিকান নৌবাহিনীর ফ্লীট অ্যাডমিরাল চেস্টার নিমিৎজ, সেনাবাহিনীর জেনারেল ডগলাস ম্যাকার্থার, জর্জ মার্শাল, হ্যাপ আর্নল্ড, জয়েন্ট চীফ অফ স্টাফ আর্নেস্ট কিং ও উইলিয়াম ডি লেহি জাপানে একটি বড় আক্রমনের পরিকল্পনা তৈরি করে যার নাম দেওয়া হয় অপারেশন ডাউনফল। এই অপারেশনে একটা সমস্যা ছিল তা হল জাপানে কখন আক্রমন করা হবে তা ঠিক করা। কারন ১৯৪৩ সালের ১৭ থেকে ২৪ আগস্ট কানাডার কিউবেক শহরে ব্রিটেন, আমেরিকা ও কানাডার মধ্যে অত্যন্ত গোপন প্রথম কিউবেক সম্মেলন হয় যাতে ঠিক করা হয়েছিল ১৯৪৭-৪৮ পর্যন্ত জাপানের মূল ভূখন্ডে আক্রমন করা হবেনা। কিন্ত আমেরিকার কম্বাইন্ড অফ চীফ স্টাফ জাপানের সাথে যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত করতে চাইছিলোনা, তিনি চাইছিলেন জার্মানির আত্মসমর্পন করার এক বছরের মধ্যেই জাপানকেও যে করেই হোক আত্মসমর্পন করানো। আমেরিকার নৌবাহিনী চাইছিলো সাংহাই, কোরিয়াতে জাপানি এয়ারবেস গুলো দখল করো সেখান থেকে জাপানে এয়ারস্ট্রাইক করতে কিন্তু আমেরিকার সেনাবাহিনী সরাসরি জাপানের মূল ভূখন্ডে আক্রমনের প্রস্তাব দেয়। শেষ পর্যন্ত আমেরিকার সেনাবাহিনীর প্রস্তাবে মান্যতা দিয়ে অপারেশন ডাউনফলের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্ত এই অপারেশনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল জাপানের খুবকম সমুদ্র সৈকতই সেনা নামিয়ে অভিযান করার মতোন উপযুক্ত ছিল। শুধুমাত্র দক্ষিন জাপানের কিউশু এবং টোকিয় শহরের একদম দক্ষিনে কান্টো প্লেন এই দুটি সুমুদ্র সৈকতই সেনা অভিযানের জন্য উপযুক্ত ছিল। তাই এই দুই সমুদ্র সৈকতের মাধ্যমে জাপানে সেনা অভিযানের জন্য অপারেশন ডাউনফলকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় অপারেশন অলিম্পিক ও অপারেশন করোনেট।
অপারেশন অলিম্পিক :— ১৯৪৫ সালের ১ নভেম্বর জাপানের কিউশু দ্বীপে সেনা অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যার নাম দেওয়া হয় অপারেশন অলিম্পিক। ৪২টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, ২৪টি যুদ্ধজাহাজ এবং ৪০০টি ডেস্ট্রয়ার ও ডেস্ট্রয়ারকে রক্ষাকারী জাহাজকে এই অভিযানের জন্য ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা হয়। আমেরিকান সেনাবাহিনীর চোদ্দটি বিভাগ এই অভিযানে অংশ নেবে ঠিক হয়। কিউশু দখল করে হোনশুতে আক্রমন করার লক্ষ্য ঠিক করেছিল আমেরিকা। অপারেশন অলিম্পিককে সফল করতে আরও একটি মিশন অপারেশন পেস্টেল দরকার হয়ে পড়ে। অপারেশন পেস্টেল অনুযায়ী জাপানকে গুপ্তচর মারফত আমেরিকা এটা বিশ্বাস করাতো যে আমেরিকা জাপানে সরাসরি আক্রমন করবেনা বরং আমেরিকা জাপানে বোম্বিং করতে চায় যাতে জাপান আমেরিকার আক্রমনের জন্য প্রস্তত না থাকে। আমেরিকান বায়ুসেনার বোম্বার বিমানগুলি এই অপারেশনে সহায়তা করতো সেনাবাহিনীকে।
অপারেশন করোনেট:— অপারেশন ডাউনফলের দ্বিতীয় ভাগ অপারেশন করোনেট যাতে ১৯৪৬ সালের ১ মার্চ কান্টো প্লেন আক্রমনের পরিকল্পনা করা হয়। অপারেশন অলিম্পিকের থেকেও বড় ছিল এই অপারেশন করোনেট যাতে ৪৫টি সেনাবিভাগ অংশ নিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান নাজিসেনার থেকে ফ্রান্সকে উদ্ধার করতে নরিম্যান্ডি অভিযান করে মিত্রশক্তি যাতে ১২টি সেনাবিভাগ ব্যবহার করা হয়েছিল সুতরাং অপারেশন করোনেট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে বড় সেনা অভিযান হতে চলেছিল।
অপারেশন অলিম্পিকে সাত লাখের অধিক সেনাবাহিনী এবল অপারেশন করোনেটে প্রায় বারো লাখ সেনা অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমেরিকার সেনাবাহিনী যখন অপারেশন ডাউনফলের পরিকল্পনা করছিলো তখন আমেরিকার অন্য এক প্রান্তে গোপনে পরমানু অস্ত্র তৈরির প্রজেক্ট চলছিলো। জার্মানি ও আমেরিকার মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রতিযোগিতা চলছিলো কে আগে পরমানু বোম্ব তৈরি করবে। আমেরিকা ও কানাডার উনিশটি প্রদেশ জুড়ে ৩৭টি বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ১,২০,০০০ মানুষ পরমানু বোম্ব তৈরির ম্যানহ্যাটেন প্রজেক্টে কাজ করছিলো। এই প্রজেক্টে সেসময় খরচ হয় দুই বিলিয়ন ডলারের বেশী অর্থ। এই প্রজেক্টে এত গোপনীয় ছিল যে আমেরিকার তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি হ্যাটি ট্রুম্যান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার আগে পর্যন্ত এই মিশন সম্পর্কে জানতে পারেনি।
নিউ মেক্সিকোর আলামোগোর্ডো বায়ুসেনা ঘাঁটিতে ১৬ জুলাই, ১৯৪৫ সালে পরমানু বোম্ব পরীক্ষা করে আমেরিকা। সেইদিনই আমেরিকা, ব্রিটেন ও চীন জাপানের বিরুদ্ধে পটসডাম ঘোষনা করে যাতে জাপানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের নির্দেশ দেওয়া হয় কিন্তু জাপান এই ঘোষনা অস্বীকার করে, এরপরেই আমেরিকা জাপনের মূল ভূখন্ডে পরমানু বোম্ব নিক্ষেপের প্রস্ততি শুরু করে। ৬ আগস্ট আমেরিকান বায়ুসেনার একটি বি ২৯ বোম্বার বিমান প্রথম পরমানু বোম্ব নিক্ষেপ করে জাপানের হিরোশিমা শহরে এবং ৯ আগস্ট দ্বিতীয় পরমানু বোম্ব নিক্ষেপ করা হয় জাপানের নাগাসাকি শহরে। এরপরেই জাপান ১০ আগট নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের প্রস্তাব দেয় এবং ১৪ আগস্ট জাপান আত্মসমর্পন করে। এভাবেই শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, জাপান আত্মসমর্পন করায় অপারেশন ডাউনফলের আর কোনও প্রয়োজন হয়নি।
তবে জাপান আত্মসমর্পন করলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপানের নিয়ন্ত্রিত মাঞ্চুরিয়া আক্রমন করে। ৯ আগস্ট যখন জাপানের নাগাসাকিতে পরমানু বোম্ব ফেলে আমেরিকা, সেইদিনই সোভিয়েত ইউনিয়ন মাঞ্চুরিয়াতে বিশাল সামরিক অভিযান শুরু করে। নভেম্বর, ১৯৪৩ সালে তেহরান সম্মেলনে এবং ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৫ সালে ইয়াল্টা সম্মেলনে আমেরিকা ও ব্রিটেনের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের চুক্তি হয় ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রশান্ত মহাসাগর বিভাগে সোভিয়েত ইউনিয়ন অংশ নেবে। জার্মানি ৮ মে আত্মসমর্পন করে, এর ঠিক তিন মাস পর ৯ আগস্ট মাঞ্চুরিয়া আক্রমন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি জোসেফ স্তালিন জাপানের আত্মসমর্পন করার আগেই জাপানের কিছু অংশ দখলের জন্য এই অভিযান শুরু করেছিল। বলা হয় আমেরিকার পরমানু বোম্ব নিক্ষেপের পরও জাপান আত্মসমর্পন করতে চাইছিলোনা কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের আক্রমনের পর একপ্রকার বাধ্য হয়েই আত্মসমর্পন করে জাপান।